
দ্বীপজেলা ভোলার ২০ লাখ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালটি অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক। যন্ত্রপাতি থাকলেও রোগীদের পরীক্ষার-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিকে।
রয়েছে খাবার ও আসবাবপত্রসংকট। যে কজন ডাক্তার আছেন তারাও অফিস করেন নিজেদের ইচ্ছামতো। এদিকে প্রায় ৫ বছর আগে নতুন বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হওয়ায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ১০০ শয্যার জনবল, আসবাবপত্র ও খাবার দিয়ে ২৫০ শয্যার কার্যক্রম পরিচালনা করায় সঠিক সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। বেড আর আসবাবপত্রের অভাবে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
জেলার সাত উপজেলার ২১ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে জেলা সদরের ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু গত দুই বছরেও হাসপাতালটির শূন্যপদে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ না হওয়ায় যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ জেলার মানুষ। ফলে হাসপাতালে এসে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। সরকারি হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই ছুটছেন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেডিসিন, সার্জারি, শিশু, গাইনি, ডায়রিয়াসহ ১৮টি ওয়ার্ড রয়েছে। হাসপাতালে ৬০ জন চিকিৎসকের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৭ জন। এর মধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আছেন ২ জন। বাকি ৪৩টি চিকিৎসকের পদই শূন্য। চিকিৎসকদের ৬০টি পদের মধ্যে সিনিয়র কনসালট্যান্ট ১০ জনের ৭টি পদ শূন্য, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ১৩ জনের মধ্যে ১০ জন, আরএমও ৪ জনের মধ্যে ৩ জন এবং অ্যানেসথেটিস্ট ৪টি পদের মধ্যে ৪টিই শূন্য।
এ ছাড়া একটি রেডিওলজিস্ট পদের মধ্যে একটিই শূন্য। চারজন মেডিকেল অফিসার পদের মধ্যে একজন, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার তিনজনের মধ্যে দুজন, সহকারী সার্জন ছয়টি পদের মধ্যে পাঁচজন, রেজিস্ট্রার ১০টি পদের মধ্যে ৯ জন এবং আয়ুর্বেদিক একটি পদের একটি পদই শূন্য রয়েছে।
এ ছাড়া ৯০ জন নার্সের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫৪ জন। বাকি পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শূন্য অবস্থায় রয়েছে। নার্সের ৩৬টি শূন্য পদের মধ্যে সেবা তত্ত্বাবধায়ক একজন, উপসেবা তত্ত্বাবধায়ক একজন, চারজন নার্সিং সুপারভাইজার পদের চারটি পদই শূন্য, সিনিয়র স্টাফ নার্সের ২০টি এবং মিডওয়াইফ ৬টি পদের সবগুলোই শূন্য।
এ ছাড়া ভোলা সদর হাসপাতাল ২৫০ শষ্যার হাসপাতাল হলেও প্রতিদিন হাসপাতালটিতে রোগী আসেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন। অথচ রোগীদের খাদ্য বরাদ্দ আছে সেই আগের ১০০ শয্যা অনুযায়ী। এতে অন্তত ১ হাজারেরও বেশি রোগী খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
২০১৩ সালে ৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যার ভোলা সদর জেনারেল হাসপাতালে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ সাত তলাবিশিষ্ট ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ভার্চুয়ালি ২৫০ শয্যার এই হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে উদ্বোধনের পর থেকেই নানা জটিলতায় ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি চলছে ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে। আর এতেই ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ জেলার বাসিন্দারা।
সরেজমিনে গত ১৮ জানুয়ারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ধারণক্ষমতার প্রায় আড়াই গুণ রোগী ভর্তি আছেন ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে। রোগীদের চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। এ ছাড়া দুপুর ২টার পরে শুধু জরুরি বিভাগে একজন চিকিৎসক ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। রোগীদের চাপে ওয়ার্ডে যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে পারছিলেন না নার্সরা।
অন্যদিকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য স্বল্পমূল্যে সরকারিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও জনবলসংকটের কারণে দুপুর ১টার পর হাসপাতালে আর কোনো পরীক্ষা করানো যায় না। বাধ্য হয়েই দুই থেকে তিন গুণ বেশি টাকা খরচ করে বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় রোগীদের। এতে বিড়ম্বনায় পড়েন চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভোলা সদর হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার আশায় আসা দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা বৃদ্ধ ওমর ফারুক ও মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘গতকাল দুপুরে ও বিকেলের দিকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আজ দুপুরে ওয়ার্ডে ডাক্তার আসছে। যদি ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার পেতাম, তাহলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হতো।’
ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদি ইউনিয়নের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শেষ ভরসা ভোলা সদর হাসপাতাল। ডাক্তার ঠিকমতো আসেন না। এতে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। এ ছাড়া সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি হাসপাতালেই করাতে পারতাম, তাহলে অনেক উপকার হতো। ডাক্তার ওয়ার্ডে এসে শুধু টেস্ট লিখে দিচ্ছেন। এখন প্রাইভেট ক্লিনিকে টেস্ট করাতে হবে।’
হাসপাতালে ভর্তি দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের মো. লাইজু বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেরে হাসপাতালে ভর্তি করাইছি। ডাক্তার টেস্ট লিখে দিছে। হাসপাতালে টেস্ট করাইতে পারি নাই, বাইরে থেকে ৩ গুণ বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করাই নিয়ে আসছি।’
রোগীর স্বজন আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘এক দিন আগে আমার আব্বারে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করাই। তাৎক্ষণিক ইমার্জেন্সিতে একজন ডাক্তার পাই। অত্যধিক ভিড় ছিল। শেষমেশ অনেক পরে ডাক্তার দেখাতে পেরেছি।’
জানতে চাইলে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স সালমা আক্তার নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বললেন, ‘এখানে নার্সসংকট তীব্র। যদি নার্সসংকট কাটানো যেত, তাহলে রোগীদের সেবাটা আরও ভালোভাবে দিতে পারতাম। আমরা আসলে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে আছি। এখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি।’
সালমা আক্তার আরও বলেন, ‘আমরা বারবার কর্তৃপক্ষের কাছে সংকট কাটানোর জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু সংকট নিরসনের ব্যবস্থা দেখছি না।’
হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সসংকট নিরসনের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শেখ সুফিয়ান রুস্তম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সের সংকট চলছে। সম্প্রতি এই সংকট জটিল আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে উঠিয়ে গিয়ে গেছে। নতুন কোনো চিকিৎসক দেয়নি। হাসপাতালে নার্সের সংকট প্রকট।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি সমস্যা দূর করার। বিষয়টি বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করছি। আশা করছি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ দিকটির প্রতি নজর দেবে এবং ভোলা সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সহায়তা করবে।’
এদিকে এসব সমস্যা ছাড়াও কর্তব্যরত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না দিয়ে অপেশাদারি আচরণের অভিযোগ রয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের অভাবে এটা ঘটছে। জনবলসংকট দূর করে রোগীদের সেবা উন্নত করার দাবি সচেতন মহলের।