
হাওর জনপদ নেত্রকোনা জেলার ১০টি উপজেলার চিকিৎসার ভরসাস্থল নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল। বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার, জরুরি রোগীসহ দুর্ঘটনায় আহতদের বাধ্য হয়ে জেলা শহরের আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসতে হয়। একদিকে অ্যাম্বুলেন্সের অব্যবস্থাপনা, অপরদিকে ডাক্তার ও জনবলের অভাবে উপজেলা থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
১৯৯২ সালে জেলা শহরের জয়নগরে প্রতিষ্ঠিত হয় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতাল। ২০০৪ সালে সেটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ইতোমধ্যে এটি কাগজেপত্রে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীতকরণ হয়েছে। তবে নতুন ছয়তলা ভবনে এখনো চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করা হয়নি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অস্ত্রোপচার, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়ার রোগীসহ দুর্ঘটনায় আহতদের আধুনিক সদর হাসপাতালে আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সীমান্তে দুর্গাপুর উপজেলা হাসপাতালে চালকের অভাবে এক মাসের বেশি সময় ধরে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। আধুনিক সদর হাসপাতালে যে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেগুলোও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সদর হাসপাতালের জরুরি রোগীদের জেলার বাইরে চিকিৎসা নিতে হয়।
নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের জরুরি রোগীদের বিভাগীয় হাসপাতালসহ ঢাকার হাসপাতালে রোগী পরিবহনে কাজ করছে ১৯টি অ্যাম্বুলেন্স। আধুনিক সদর হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ৯৫০ টাকা। অপরদিকে একই দূরত্বে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে যেতে ভাড়া লাগে ২ হাজার টাকার চেয়ে বেশি।
দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আসা অসুস্থ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছি। শীতকাল এলেই যন্ত্রণা বাড়ে, তাই দুর্গাপুর উপজেলা হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ থাকায় প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে আড়াই হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে এসেছি। অথচ সরকারনির্ধারিত ভাড়া এর অর্ধেক।’
এ ছাড়া হাসপাতালের পয়োনিষ্কাশনেও ব্যাপক অব্যবস্থাপনা। চিকিৎসাধীন রোগীদের হিমশিম খেতে হয়। টয়লেটগুলো উপচে থাকে নোংরা ময়লা দিয়ে। দুর্গন্ধে ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় এই নোংরা অবস্থাতেও রোগীদের এসব টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত জনবলের অভাব থাকায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে নিচতলায় বিভিন্ন তলার মেঝে ও দেয়ালে ধুলোর পাশাপাশি ময়লা ও হলুদ দাগ লেগে থাকতে দেখা গেছে। দুর্গন্ধের পাশাপাশি ড্রেনগুলো আবর্জনায় ভর্তি হয়ে থাকে। চারদিকে উড়তে দেখা গেছে মশা-মাছি।
এদিকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসকদের নির্ধারিত সময়ে আসা-যাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে স্থানীয় রোগীদের দাবি, হাসপাতালের প্রবেশ পথে কোন রুমে কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কোন সময় পর্যন্ত চেম্বারে বসেন, তাদের মোবাইল ফোন নম্বরসহ নির্দিষ্ট বোর্ড টাঙানো থাকলে রোগীদের চিকিৎসা পেতে সুবিধা হতো।
দাঁতের ব্যথার রোগী মোহনগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা কাজল সাহা বলেন, ‘এই হাসপাতালে অনেক রোগের চিকিৎসক নেই। দাঁত দেখাতে এসে দেখি, যিনি আছেন, তিনি পূর্ণাঙ্গ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নন। তাই হয় ময়মনসিংহ হাসপাতালে যেতে হবে, না হলে নেত্রকোনায় বাইরে থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে দন্ত চিকিৎসক না থাকায় অতিরিক্ত ফি গুনতে হবে।’
জরুরি শিশুর চিকিৎসা নিতে অক্সিজেন সরবরাহের যে কয়টি বক্স আছে, তাতে শিশুর চিকিৎসাসেবা প্রদান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বারহাট্টা থেকে আসা সজল মিয়ার ছেলের জন্ম প্রাইভেট ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারে। সমস্যা হওয়ায় ডাক্তার সদর হাসপাতালে কাচের বক্সে (ইনকিউবিটর) রাখতে পরামর্শ দেন। তিনি তৎক্ষণাৎ এখানে এসে দেখেন কোন বক্স খালি নেই। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হন।
হাসপাতালে কর্মরত প্রধান সহকারী নিতাই চন্দ্র দাস জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ৪৪ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ২৪ জন। এর মধ্যে কার্ডিওলজি, ইএনটি, শিশু, প্যাথলজি, গাইনি, অ্যানেসথেশিয়া বিভাগে সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং প্যাথলজি, চর্ম ও যৌন বিভাগে জুনিয়র কনসালট্যান্টের পদ শূন্য। এ ছাড়া চক্ষু, মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র, জুনিয়র দুই কনসালট্যান্টেরই পদ শূন্য। একই সঙ্গে পদ শূন্য রয়েছে ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার হোমে একজন করে ও সহকারী সার্জন। পাশাপাশি তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও অনেক পদ শূন্য রয়েছে।
নিচতলায় রক্ত পরীক্ষা করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে না পেরে চলে যাচ্ছিলেন সাতপাই কলেজ রোডের বাসিন্দা অসুস্থ ফারুক মিয়া। তিনি বলেন, ‘আর কত দাঁড়িয়ে থাকব? সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আছি, খাওয়া-দাওয়া করি নাই। তাই বাসায় চলে যাচ্ছি। প্রাইভেট ক্লিনিকে পরীক্ষা করে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। তর্ক করে লাভ নেই এখানে। কে শুনবে কথা? প্রাইভেট ক্লিনিকে পরীক্ষা করাতে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে টাকা বেশি খরচ হবে, কিন্তু দ্রুত কাজ হবে।’
এ বিষয়ে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু সাঈদ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালটি ১০০ থেকে ইতোমধ্যে ২৫০ সিটে রূপান্তর করা হয়েছে। তবে নতুন ছয়তলা ভবনে এখনো চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করা হয়নি। হাসপাতালে চিকিৎকের পদের অর্ধেকেই শূন্য রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। অন্যান্য পদেও লোকবল নেই। রোগীর সংখ্যাও অতীতের তুলনায় বেড়েছে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও সেবা প্রদান করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।’