
নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতিতে ভরা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ১ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটারের ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৫৯ জন জনসংখ্যার চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই জনসংখ্যার চিকিৎসায় বিশ্বাসভঙ্গ করছেন উপজেলা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই সঙ্গে রয়েছে জনবল সংকট। এই অজুহাতে অনিয়ম জেনেও নীরব কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডাক্তারের পরিবর্তে চিকিৎসা দিচ্ছেন টেকনোলজিস্ট।
ইসিজি করান মাস্টার রোলে নিয়োগ পাওয়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। দীর্ঘদিন বিকল ইসিজি মেশিন। ফিল্ম সংকটে এক্সরে করাতে পারছেন না সাধারণ রোগীরা। পাঁচটি ইসিজি মেশিন থাকলেও তালাবদ্ধ ইসিজি কক্ষ। এই পাঁচ মেশিনের জন্য লোক নিয়োগ করা হয়েছে দুইজন। রয়েছে মাত্র একজন কার্ডিওগ্রাফার আর একজন ইপিআই টেকনিশিয়ান। একটি মেশিন ভালো থাকলেও ইসিজি করার দায়িত্বে আছেন চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী। ইসিজি মেশিনটি রাখা হয়েছে আলট্রাসনোগ্রাম কক্ষে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কার্ডিওগ্রাফার রায়হান দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে অনুপস্থিত। আরেকজন টেকনিশিয়ান মোশাররফ বসেছেন প্যাথলজি বিভাগে রসিদ কাটতে। অভিযোগ রয়েছে, ইসিজি কক্ষের কার্ডিওগ্রাফার রায়হান কোনো কাজ না করে বসে বসে বেতন নিচ্ছেন।
এদিকে চিকিৎসকরাও মানছেন না হাসপাতালের আগমন এবং প্রস্থানের সময়। সরেজমিনে দেখা যায় ১০টার পর উপস্থিত হয়েছেন চিকিৎসকরা। ফলে রোগীরা অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আবার ১২টার পরই কিছু কিছু চিকিৎসাসেবা দেওয়া বন্ধ করে কক্ষ ত্যাগ করেছেন। ফলে ফেরত যেতে হয়েছে রোগীদের।
প্রতিদিন গঙ্গাচড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ৫৫০ থেকে ৭৫০ রোগী আসেন। রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মরত চিকিৎসকরা। জরুরি বিভাগের কার্যক্রমও চলছে পিয়ন কিংবা স্বাস্থ্য সহকারী দিয়ে- এমন অভিযোগ রয়েছে সেবা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনদের।
গঙ্গাচড়া উপজেলার চিকিৎসা নিতে আসা রুকাইয়া আক্তার বলেন, ‘ডাক্তার দেখাতে হবে। এসে দেখি ১২টা বাজামাত্র চলে গেছে।’ উপজেলার বড়াইবাড়ির গর্ভবতী আয়শা সিদ্দিকা এসেছেন পরীক্ষা করাতে। তাকে দেওয়া হয়েছে এইচবিএসএজি পরীক্ষা। নোটিশে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৫০ টাকা। কিন্তু ফি ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। কেন বেশি ধরা হয়েছে জানতে চাইলে মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট স্বপ্না বলেন, ‘এই পরীক্ষাটি করার রেজিমেন্ট এখানে নেই।
স্যারদের অনুমতি নিয়ে সেবা দেওয়ার জন্য বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি। তাই একটু বেশি টাকা নিচ্ছি।’
জানা যায়, মেডিকেলের স্টাফরা মেশিনগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে অকেজো করে হাসপাতালের রোগীকে বাইরের প্যাথলজিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে থাকেন। বেসরকারি প্যাথলজিগুলো থেকে রোগী অনুযায়ী কমিশন নিয়ে থাকেন তারা। এ কাজে তাদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গঙ্গাচড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে যথেষ্ট জনবলের অভাব। ২১ পদের বিপরীতে বর্তমানে ১৩ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। ১০ জন কনসালট্যান্ট চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন সাতজন। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের পদটিও শূন্য।
দ্বিতীয় শ্রেণির মঞ্জুরীকৃত ৯৩ পদের বিপরীতে ৩৫ জনের পদ শূন্য। বিভিন্ন ইউনিয়নের উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্ত করে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা।
জানা যায়, ৩১ শয্যার এই হাসপাতালটি ২০১১ সালে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মঞ্জুরীকৃত ২১ চিকিৎসকের মধ্যে তিনজন কনসালট্যান্টসহ বর্তমানে মোট আটজনের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে মেডিকেল অফিসার একজন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) একজন, জুনিয়র কলসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) একজন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চক্ষু) একজন, মেডিকেল অফিসার ইউনানি একজন এবং অ্যানেসথেসিওলজিস্ট একজন।
এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ৯৩টি পদের বিপরীতে ৩৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সহকারী ১৫ জন, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক সাতজন, ফার্মাসিস্ট দুইজন, পরিসংখ্যানবিদ একজন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট একজন, জুনিয়র মেকানিক একজনসহ প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক পদটি অবসরজনিত কারণে গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে শূন্য। সহকারী নার্সের একটি পদ শূন্য।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আলেমুল বাশার জানান, ‘এখানে জনবল সংকট রয়েছে কিছুটা। ডেন্টিস্ট দুই মাসের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং থাকার কারণে টেকনোলজিস্ট দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’ সিন্ডিকেটের বিষয়ে অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম শুনলাম, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’