
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সারি সারি মোটরসাইকেল দেখা যায়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান নিয়ে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের (প্রেসক্রিপশন) ছবি তোলেন।
চিকিৎসক নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখেছেন কি না তা তারা যাচাই করেন। আগে থেকেই তারা চিকিৎসককে ওই কোম্পানির ওষুধ লিখতে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে থাকেন। একইভাবে বহির্বিভাগে রয়েছে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশন এজেন্ট ও দালালের উৎপাত।
সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও কমিশনের বিনিময়ে সাধারণ রোগীদের ওইসব ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে বাইরের ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে রোগীদের রীতিমতো ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নির্দিষ্ট প্যাথলজি ক্লিনিকের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়েছেন হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকও। এভাবে খোলামেলা কমিশন বাণিজ্যের কারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় রোগীদের। গত দুই দিন সরেজমিনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এসব চিত্র দেখা যায়।
রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বহির্বিভাগে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীর ভিড় বাড়লেও দায়িত্বরত চিকিৎসকরা আসেন ১১টা-১২টার পর। তাদের অধিকাংশই রোগীর ব্যবস্থাপত্রে কোনো ধরনের ওষুধ লেখা ছাড়াই পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট বেসরকারি প্যাথলজিতে পাঠিয়ে দেন। পরীক্ষার পর ওই রিপোর্ট পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু দুপুরের পর ওই চিকিৎসক চেম্বারেও থাকেন না। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীসহ তার স্বজনদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দালালদের মাধ্যমে রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে এনে এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে টেস্ট বাণিজ্য। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন প্যাথলজি বিভাগ, ডিপ্লোমাধারী প্যাথলজিস্ট নেই। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
অভিযোগ রয়েছে, গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের টার্গেট করে চক্রটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে প্রতারণা করছে। ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করে অনেকে চিকিৎসা নিতে এখানে আসেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় জরুরি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে প্যাথলজিতে ‘ইভিনিং সিফট’ চালু করা হয়েছে। রাত ৮টা পর্যন্ত সেখানে স্যাম্পল নেওয়া হবে এবং রাত ৯টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়া হবে। এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে কি না তা নিয়মিত মনিটরিং করা হবে।
হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বামী খলিলুর রহমান জানান, তার স্ত্রী এক সপ্তাহ ধরে পেটের ব্যথায় ছটফট করছেন। হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসক কয়েকটি মেডিকেল টেস্ট দিয়েছেন। যার মধ্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়সহ সব পরীক্ষা দালালের মাধ্যমে বাইরের সুগন্ধা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করতে হয়েছে। নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক ছাড়া অন্য কোথাও থেকে পরীক্ষা করালে সেই রিপোর্ট চিকিৎসকরা দেখতে চান না। অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার আবার মনগড়া রিপোর্টও দিয়ে থাকে।
খুমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, সরকারি হাসপাতালে প্যাথলজি সুবিধা থাকলেও কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে স্লিপ দিয়ে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। যদি বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতে হয়, তা হলে হাসপাতালের নার্স রক্ত সংগ্রহ করে দেবেন।
তার পর রোগীর স্বজনরা পছন্দমতো প্যাথলজিতে নিয়ে তা পরীক্ষা করবেন। কিন্তু কোনো চিকিৎসক তার পছন্দমতো ল্যাবে রোগী পাঠাবেন না। বাইরে থেকে কেউ হাসপাতালে এসে রোগীর রক্ত সংগ্রহ করতে পারবেন না। অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের যখন-তখন হাসপাতালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। তারা হাসপাতালে ঢুকলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। নির্দেশনা না মানলে চিরদিনের জন্য তাদেরকে হাসপাতাল চত্বরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হবে।
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মহাসিন আলী ফরাজী বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৫শ-৭শ রোগী বহির্বিভাগে আসেন। তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে ভোগান্তির শিকার হন। টিকিটের জন্য লাইনে থাকা অবস্থায় সেখান থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়া হয়। আমরা এই সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছি। বহির্বিভাগে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত নামে কোনো কক্ষ থাকবে না। ফটকের বাইরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধীনে মেডিকেল অফিসার পদবি লেখা থাকবে।