সম্প্রতি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নে বালতির পর বালতিভর্তি ককটেল ফাটিয়ে আলোচনায় আসে এই এলাকা। কিছু হলেই এখানে বিস্ফোরণ ঘটে। আধিপত্য নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব চলছে ২২ বছর ধরে। এই সময়ে ককটেল বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০০ জন। অঙ্গহানি হয়েছে শতাধিক মানুষের।
রাজনৈতিক প্রভাবে এতদিন বিরোধ থামানো যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, সন্ত্রাসীদের আটক এবং বোমা উদ্ধারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ৫ এপ্রিল দুই পক্ষের সংঘর্ষে শতাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণ হয়। একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, গ্রামের লোকজন একে অপরের দিকে হাতবোমা ছুড়ছে। দেখে মনে হয়, যুদ্ধ চলছে।
এই সংঘর্ষ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিলাসপুরে আধিপত্যের লড়াই চলছে ৪১ বছর ধরে। কেবল বোমার আঘাতে প্রাণ গেছে আটজনের।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল বোমার আঘাতে নিহত হয় ১৫ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষার্থী সৈকত মুন্সী। তার মা শাহনাজ আক্তার প্রিয় সন্তান হারিয়ে এখনো শোকে পাগলপ্রায়। সৈকতের বাড়িতেও এরপর বোমা হামলা হয়। বিচার না পেয়ে হতাশ পরিবার। একই বছর ২৭ মার্চ বোমার আঘাতে মারা যায় ২৫ বছর বয়সী যুবক সজীব।
সজীবের মা জানান, ছেলের পেট থেকে ৩৭টি তারকাটা বের করা হয়। আরও ১১টি রয়ে যায় শরীরে। সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যায় সে।
সজীবের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘দুই বছরের সন্তান রেখে সজীব মারা যান। সবাই বাবাকে নিয়ে ঈদ করে, আমার সন্তান করেছে বাবাহীন ঈদ। স্বামী ছাড়া ঈদ কতটা কষ্টের, আমি জানি। বিচার এখনো পাইনি।’
গত ১০ বছরে বোমার আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। গ্রামজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিরোধ শুরু ১৯৮৪ সালে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। মেছের মাস্টার ও আনোয়ার হোসেনের মধ্যে বিরোধে শুরু হয় বোমাবাজি। ২০০১ সাল পর্যন্ত তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে।
এরপর নেতৃত্বে আসেন আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান কুদ্দুস ব্যাপারী। তার প্রতিপক্ষ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জলিল মাদবর। এই দুপক্ষের মধ্যে গত ২২ বছরে শতাধিক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এলাকার ব্যবসা ও সামাজিক অনুষ্ঠানে।
স্থানীয়রা জানান, এক পক্ষকে নেতৃত্ব দিতেন সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। অন্যপক্ষকে নেতৃত্ব দিতেন সাবেক এমপি ইকবাল হোসেন অপু। তারা কখনো সমঝোতার চেষ্টা করেননি।
কেন নিজেরা নিজেদের মারছেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে দুই নাম-বোকা কুদ্দুস’ ও ‘বোমা জলিল’।
কুদ্দুস বিলাসপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি ২০০১ সালে প্রথম বোমাবাজি শুরু করেন। চরের জমি দখল, নদীপথ, বালু ও মাছ শিকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।
জলিল মাদবর ছিলেন কুদ্দুসের প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনিও বোমাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন। কুদ্দুস সরদার বলেন, ‘ক্ষমতা আর আদম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মারামারি হয়। কেউ দলে যেতে না চাইলেও জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়।’
মন্নান শিকদার, আক্কাস সিকদার ও রোজীনা বেগম বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই। মারামারি চাই না। সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারি না।’ অনেক পরিবার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে বলছে, ‘সুযোগ পেলে বাড়ি বিক্রি করে চলে যাব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে নৌপথে আসে বোমা তৈরির উপকরণ। শত শত বোমা তৈরি হয় চরে কিংবা নৌকায় বসে। প্রতি ১০০টি বোমা বানিয়ে পাওয়া যায় ৪০ হাজার টাকা। একটি বোমা বানাতে সময় লাগে ৪-৫ মিনিট।
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দুলাল আখন্দ জানান, ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এতদিন সংঘর্ষ থামানো যায়নি। এখন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। পরে আবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।’
পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউপি চেয়ারম্যান কুদ্দুস ব্যাপারীর বিরুদ্ধে ৪৭টি ও জলিল মাদবরের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলা রয়েছে। বর্তমানে তারা দুজনই কারাগারে আছেন।