
বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ্ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। তারা বাড়ি দুইটির সীমানা প্রাচীর, প্রধান ফটক ও বাড়ির সামনের অংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি আসবাবপত্রে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ওই দুই বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। একইসঙ্গে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠান অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড চেয়ারম্যান আবদুস সবুর খানের বাসভবন।
নগরীর কালিবাড়ি রোডের ‘সেরনিয়বাত ভবন’টি শেখ হাসিনার ফুপা সাবেক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি। ওই বাড়িতে বসবাস করতেন রব সেরনিয়াবাতের দৌহিত্র ও আওয়ামী লীগের প্রভাশালী নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লার বড় ছেলে সাবেক মেয়র সেরনিয়বাত সাদিক আবদুল্লাহ। নগরীর বগুড়া রোডে একই কম্পাউন্ডে আমির হোসেন আমু ও আবদুস সবুর খানের বাড়ি। সম্পর্কে তারা দুইজন আপন মামাতো-ফুপাতো ভাই।
ছবি: খবরের কাগজ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল অধিবেশনকে কেন্দ্র করে ‘দেশব্যাপী বুলডোজার-৩২ কর্মসূচি’র ঘোষণার পর বরিশালেও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১১টার দিকেই নগরীর কালিবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবনটি পুলিশ ঘিরে রাখে। ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও কালিবাড়ি রোডে আসেন। প্রায় একই সময়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে কালিবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবনমুখী হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সড়কের দুইপাশ থেকেই প্রবেশে বাধা দিলেও ছাত্র-জনতা তা উপেক্ষা করে সেরনিয়াবাত ভবনের ভেতর ঢুকে যান। এসময় তারা পরিত্যক্ত বাড়ির বিভিন্ন তলায় গিয়ে পড়ে থাকা ভাঙা আসবাবপত্র ও গ্লাস ভাঙচুর করে।
পরে রাত ১টার দিকে এক্সকেভেটর এনে বাড়ি ভাঙার জন্য ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাতে বাধা দেন। কিন্তু শিক্ষর্থীরা সেই বাধা উপেক্ষা করে সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর বাসভবনের সীমানাপ্রাচীর গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তারা ভেতরে প্রবেশ করে ভবনের সামনের অংশ, গাড়ির গেরেজ ও টিনসেডের অংশবিশেষ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তারা নগরীর বগুড়া রোডের আমির হোসেন আমুর বাসভবন ভাঙচুর চালায়। সেখানে একতলা ভবনের সামনের অংশ, একটি দ্বিতল ভবনের সামনের অংশ এবং সীমানা প্রাচীর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় তারা।
পরে রাত আড়াইটার দিকে শিক্ষার্থীরা এক্সকেভেটর দিয়ে আমির হোসেন আমুর বাসভবনের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশে করে ভাঙচুর চালায়। পাশাপাশি ভেতরে থাকা বিভিন্ন মালামাল বাড়ির সামনে জড়ো করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময়ে কিছু মানুষ বিভিন্ন মালামাল লুট করতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তাতে বাধা দেয়।
ছবি: খবরের কাগজ
এদিকে সরেজমিনের ওই দুই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের ও নানা শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ ওই বাড়ির সামনে ভিড় করছেন। তারা কেউ কেউ ভিডিও করছেন, কেউ কেউ ছবি তুলছে। আবার বাড়ির ভেতরের বিভিন্ন কক্ষে বারান্দায় বসে সেলফি তুলছেন।
সেরনিয়াবাত ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১১টা পর্যন্ত দুই তলা বিশিষ্ট ভবনের বিভিন্ন কক্ষ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সকাল থেকে শত শত মানুষ বাড়ির সামেনে ভিড় করেছে পোড়া বাড়ি দেখার জন্য। এতে দুপুর ৩টা পর্যন্ত কালী বাড়ির রোডে যানজটের সৃষ্টি হয়।
এদিকে বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ভোররাতে নগরীর বগুড়া রোডের আমির হোসেন আমুর বাড়ির প্রধান ফটক ও সীমানা প্রাচীর এক্সকেভেটর দিয়ে ভেঙে ফেলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এ সময়ে কিশোর বয়সের কয়েকজন হাতুড়ি, লোহার রড ও বিভিন্ন সরঞ্জাম হাতে নিয়ে বাড়িরটি দুইতলা ও নিচতলায় দরজা জানালাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করছে। পাশাপাশি গত ৫ আগস্ট বিকেল লুটের পরে বাড়িতে থাকা অবশিষ্ট ইলেকট্রনিক্স ও আসবাবপত্র অটোরিকশাযোগে এবং হাতে করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এদিকে ওই কম্পাউন্ডে থাকা অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড চেয়ারম্যান আবদুস সবুর খানের বাড়িতে ওই কিশোররা প্রবেশ করে তিনতলার বাড়ির প্রায় ২০টি কক্ষে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরে করে।
স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্ট আমির হোসেন আমুর বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হলেও সবুর খানের বাড়ির কাছে কেউ আসেনি। কিন্তু গতকাল রাত ১১টার পরে তিন চারজন কিশোর ওই ভবনের ঢুকে হামলা ও ভাঙচুর করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় নানা বয়সের নারী ও বেশ কিছু শিক্ষার্থীরা।
তারা বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে আলমিরা, ওয়ারড্রব, শোকেস, বুক সেলফ, শিশুদের বিভিন্ন প্রকার খেলনা, রান্না ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এ সময়ে নারী ও কিশোরদের বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যাগ ও বস্তা ভরতে দেখা যায়। বিভিন্ন কক্ষে থাকা এসি, ফ্যান, বই, রানা ঘরের বিভিন্ন উপকরণ, লেপ-তোশক, কাঁথা-বালিশসহ বিভিন্ন মামলামাল লুট করা হয়।
বরিশাল বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, দেশের বাহিরে থেকে পালাতক, খুনি, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসররা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। দেশের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করার পায়তারা করছে। ফ্যাসিস্টদের মূল উৎপাটনে জনগণের টাকায় বানানো বাড়িঘরে আজকের এ প্রোগ্রাম।
নাঈম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, কালিবাড়ি রোড ও বগুড়া রোডের এ ভবনগুলোতে ফ্যাসিবাদের আস্তানা। আমরা বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কোনো আস্তানা রাখতে চাই না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন আজকের কর্মকাণ্ড। তাই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম শাহেদ বলেন, বিক্ষুব্ধ জনতা ফ্যাসিবাদের দোসরদের আস্তানা ভেঙে দিচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ কোনো বক্তব্য দিতে কেউ রাজি হননি।
উল্লেখ্য ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবরের পর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর কালিবাড়ি রোডের বাসভবন এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর বগুড়া রোডের বাসভবনে আগুন দিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। যে ঘটনায় সাদিক আব্দুল্লাহর বাসা থেকে বিসিসির সাবেক প্যানেল মেয়র গাজি নইমুল ইসলাম লিটুসহ তিন আওয়ামী লীগ কর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
মঈনুল ইসলাম সবুজ/মাহফুজ