
খুলনার বড়বাজারের সংকীর্ণ অলিগলিতে গড়ে উঠছে অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অনেক জায়গায় পাশাপাশি দুইজনের যাতায়াতের পথও নেই। বাজারের এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানে দিনের বেলায় সূর্যের আলো পৌঁছায় না। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের বৈদ্যুতিক বাতির ওপর ভরসা করতে হয়।
কোনো কারণে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বাজারের ভেতরে প্রবেশের সুযোগও নেই। ফলে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বাজারটি রয়েছে চরম অগ্নিঝুঁকিতে।
একইভাবে খুলনার কেডি ঘোষ রোডের হেরাজ মার্কেট, ডাকবাংলা মোড়ের শহিদ সোহরাওয়ার্দী মার্কেট, রেলওয়ে হাসপাতাল রোডের জব্বার মার্কেট, চাঁদনী চক মার্কেট, মানিক মিয়া মার্কেট, ক্লে রোডের খানজাহান আলী হকার্স মার্কেট, মশিউর রহমান মার্কেটও রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে।
শুধু খুলনা নগর নয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় প্রায় ৬৯৪টি মার্কেট, শপিংমল, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। এর মধ্যে ২০টি ‘অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ’, ৫৫৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ১২১টি ‘কম ঝুঁকিপূর্ণ’ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে।
নাগরিক নেতারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মার্কেটগুলো অপসারণে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খুলনা নগরীর লোয়ার যশোর রোডে ৫০ বছরের পুরোনো হোটেল মুন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ভবনটি ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
২০১০ সালে সিটি করপোরেশনের ২০তম সাধারণ সভায় এই ভবনটিসহ ‘অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ’ ও বসবাসের অনুপযোগী ২৬টি বাড়ি ভেঙে অপসারণের জন্য বাড়ির মালিকদের নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিদর্শনে খুলনা জেলার ৭৩টি মার্কেট, আবাসিক হোটেল, শ্রমিক কোয়ার্টার, রাইস মিল ও জুট মিল ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হয়।
তালিকা অনুযায়ী, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাগেরহাটের বনলতা, চিত্রা, সঙ্গীতা, নীলপদ্ম, ফকিরহাট উপজেলা আবাসিক কোয়ার্টার ও টাউন নওয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যশোরের এস কে রোডের এমএস অর্কিড সেন্টার, বি কে রোডের পূর্বাচল টাওয়ার, বিসিক আদ দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালস, এইএমএম রোডের বঙ্গবাজার মার্কেট, হাটচান্নি মার্কেট, বড় বাজার কাপুড়িয়াপট্টি মার্কেট, চুড়িপট্টির চৌধুরী মার্কেট, কাপুড়িয়াপট্টি রোডের হোটেল নয়ন আবাসিক অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
এ ছাড়া ঝিনাইদহের শৈলকুপার কুটুমবাড়ি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট, ভাই ভাই হোটেল, জামান রেস্তোরাঁ, মিতু বেকারি, মাগুরার ফাতেমা কটন মিল, নড়াইলের জেলা অ্যাকাউন্টস অফিস, জেলা সদর হাসপাতাল, কালিয়ার বিআরডিবি অফিস, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওষুধ বিতরণ ভবন, মেহেরপুরের পোস্ট অফিস ভবন ও গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন ‘অত্যধিক ঝুঁকিতে’ রয়েছে।
জানা গেছে, যশোরে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ২৫৮টি, ঝিনাইদহে ১৮৫টি, মাগুরায় ৮৮টি, নড়াইলে ২৮টি, কুষ্টিয়ায় ১৮টি, চুয়াডাঙ্গায় ৯টি ও মেহেরপুরে ২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান জানান, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ায় কমিটি গঠন করে নিজ নিজ দপ্তরের আওতায় অতিঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়। এসব ভবনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়।
এদিকে খুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পাশাপাশি নকশাবহির্ভূত অবৈধ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। নোটিশ দেওয়ার পরও অনেক সময় অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ্জামান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকায় ভবনগুলোর ৯০ ভাগই নকশাবহির্ভূত। কোনোটি চারতলার অনুমোদন নিয়ে পাঁচতলা করা হয়েছে। প্রথমতলা নিজের ভূমির ওপর করলেও দ্বিতীয়তলা থেকে ড্রেন ও রাস্তার দিকে বাড়িয়ে করা হয়েছে। কর্মকর্তারা মাঠে তদারকি করলে এসব অবৈধ ভবন নির্মিত হতো না। এ ক্ষেত্রে নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণ বন্ধে শুধু কেডিএ নয়, সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরগুলোকেও সক্রিয় হতে হবে।’
কেডিএ অথরাইজড অফিসার জি এম মাসুদুর রহমান জানান, অভিযানে বেশকিছু ভবনের নকশাবহির্ভূত অংশ অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওইসব ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি পরিকল্পিত নগরায়ণের স্বার্থে ও ভবন মালিকদের আর্থিক ক্ষতি কমাতে দখলের মাধ্যমে কোনো নির্মাণকাজ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।