
হবিগঞ্জ শহরের বাইপাস সড়ক। এই পথের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। বর্ষায় শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য এই খালটি স্থানীয়দের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেখানে চোখ পড়েছে দখলদারের। খালের পানিপ্রবাহের পথ আটকে সেখানে মাটি ফেলা হয়েছে। বানানো হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে প্রবেশের পথ। এতে আগামী বর্ষা মৌসুমে শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতা আর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রভাবশালীরা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের জমি তথা খালের জমি দখল করেছে। শুধু এই জায়গা নয়, শহরের একাধিক জায়গায় সওজের জমি এভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা শিগগিরই অভিযান চালানোর আশ্বাস দিয়েছেন।
বাইপাস সড়ক ঘুরে দেখা যায়, নতুন স্টেডিয়াম-সংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠছে সাহিদ চক্ষু হাসপাতাল। এই প্রতিষ্ঠানটিও সামনের অংশের খাল ভরাট করে ফেলেছে। এ ছাড়া খাল ভরাট করেছে রাজনগর এতিমখানা ঘেঁষা মদিনা কার সেন্টার, কুইক ওয়াশ এবং একটি ফাস্টফুড প্রতিষ্ঠান। এর বাইরেও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি বাড়ির রাস্তা নির্মাণের জন্য খাল ভরাট করেছেন। সরকারি জায়গায় গড়ে তুলেছেন ছোট-ছোট বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
এর আগে হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ-সংলগ্ন বাইপাসে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের জায়গা দখল করে দোকানঘর নির্মাণ করে মাছবাজার আড়ত সমিতি। এ বিষয়ে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর খবরের কাগজে ‘হবিগঞ্জে সওজের ১০ কোটি টাকার জমি দখল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর তিন দিন পর সেখানে অভিযান চালিয়ে ৮৪ শতক জায়গা উদ্ধার করে জেলা প্রশাসন ও সড়ক বিভাগ।
সর্বশেষ অভিযোগ উঠেছে কুইন মেরি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। রাজনগর এলাকায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি সওজের খাল ভরাট করে প্রবেশপথ তৈরি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালের চেয়ারম্যান পৌর জাসাসের সভাপতি নূর উদ্দিন জায়গাটি দখল করেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, এটি পরিবেশ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
শুধু কুইন মেরি হাসপাতালই নয়, সড়কের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সরকারি খাল দখল হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ কাজে সরাসরি জড়িত এবং সওজ বিভাগ যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
রাজনগর এলাকার বাসিন্দা জসিম মিয়া বলেন, ‘এ খাল দিয়ে শহরের একটি অংশের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয়। কিন্তু কুইন মেরি হাসপাতাল সেই পথটি ভরাট করে ফেলছে। আগামী মৌসুমে বৃষ্টির পানি নামতে পারবে না। এতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে আমাদের পড়তে হবে।’
একই এলাকার শাহীন মিয়া বলেন, ‘সরকারি জায়গা আমাদের সবার সম্পদ। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কিছু লোক এগুলো দখল করছে। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না বলেই তারা এভাবে দখল করতে পারছে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হবিগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘সরকারি জায়গা এভাবে দখল হতে থাকলে শুধু পরিবেশ নয়, সামগ্রিক নগরব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। বাইপাস সড়কের দুইপাশের খাল শহরের পানি নিষ্কাশনের একটি বড় মাধ্যম। কিন্তু এ খালটি যেভাবে দখল হচ্ছে এতে আগামী বৃষ্টির মৌসুমে শহরের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
পরিবেশকর্মী ও কবি তাহমিনা বেগম গিনি বলেন, ‘আমাদের শহরে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। কারণ খালগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রশাসনের উচিত দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া।’
খাল দখল ও ভরাটের বিষয়ে কুইন মেরি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সড়ক বিভাগের অনুমতি নিয়েই জায়গাটি ভরাট করেছি। নিয়ম-নীতি মেনেই প্রবেশপথ তৈরি করেছি। এখানে কোনো অবৈধ দখলের বিষয় নেই। তবে সড়ক বিভাগ আমাদের একটি কালভার্ট নির্মাণের জন্য বলেছিল, সেটি আমরা করিনি। পর্যায়ক্রমে ভরাট করা অংশ কেটে কালভার্ট তৈরি করা হবে। এর বাইরে যদি কোনো সমস্যা থাকে, আমরা সেটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব।’
সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, ‘ভরাট করা অংশ থেকে মাটি অপসারণের জন্য আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু তারা এখনো মাটি অপসারণ করেনি। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া বাইপাসে যত অবৈধ দখল আছে সেগুলো উদ্ধারে শিগগিরই আমরা অভিযান শুরু করব।’