
যশোরের অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলাকে বিভক্ত করেছে টেকা (মুক্তেশ্বরী) নদী। একপাশে অভয়নগরের পায়রা ইউনিয়ন, অন্য পাশে মনিরামপুরের নেহালপুর। দুই পাশের মানুষের যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে ১৯৮০ সালে এখানে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘদিনের পুরোনো সেতুটি ভেঙে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর নতুন সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৭ মার্চ। অথচ সেই সেতুর কাজ এখনো শেষ হয়নি। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন দুই উপজেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। যদিও এমন পরিস্থিতির জন্য একাধিক পক্ষ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে দায়ী করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নদী আইন অনুযায়ী নির্মাণাধীন সেতুর উচ্চতা ঠিক না থাকায় একজন অধিকারকর্মী উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। এরপর ছয় মাসের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের দেওয়া সেই সময়ও অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
রিটকারী ওই উন্নয়নকর্মী সঠিক সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন। তবে এলজিইডি বলছে, আইনি জটিলতার কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, আদালতের নির্দেশ মেনে কাজ চলছিল। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় নির্মাণসামগ্রী লুট করে তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কাজ শেষ হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদী আইন অনুযায়ী টেকেরঘাট সেতুসহ যশোরের কয়েকটি সেতুর উচ্চতা ঠিক না থাকায় উচ্চ আদালতে ২০২৩ সালের জুন মাসে রিট করেন ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ। রিটের শুনানিতে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন।
আদেশে অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুসারে সেতু নির্মাণে যথাযথ উল্লম্ব-অনুভূমিক জায়গা রাখতে বলা হয় (এতে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ঠিক থাকবে ও নৌপরিবহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে না)। এ ছাড়া এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতির বিষয়ে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী, যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চার বিবাদীকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিবেদন দাখিলের পর ছয় মাসের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে বলা হয়। কিন্তু এখনো সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। বর্তমানে কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘খুলনা বিভাগীয় অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় আট কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকার কাজটি পায় মোজাহার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত সেই কাজ শেষ করতে পারেনি। অসমাপ্ত সেতুর পাশে একটি কাঠের তৈরি বিকল্প সেতু দিয়ে ছোট যানবাহন ও মানুষ চলাচল করছে। তবে বিকল্প এ সেতু দিয়ে চলাচলে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ভবদহ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুল মতলেব বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডসহ কোনো মালামাল সেখানে নেই।
অসমাপ্ত সেতুর পাশে একটি কাঠের তৈরি বিকল্প সেতু দিয়ে ছোট যানবাহন ও মানুষ চলাচল করছে। সেতু না হওয়ায় দুই উপজেলার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কাঠের তৈরি বিকল্প সেতু দিয়ে চলাচল করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ না হলে দুই উপজেলার মানুষ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট একজন বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ মেনে কাজ চলছিল। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর নির্মাণসামগ্রীসহ অন্য মালামাল লুট হয়ে যায়। আমাদের লোকজনকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।’
রিটকারী ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী কাজ শেষ করে রিপোর্ট করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। অনেক আগেই আদালতের দেওয়া সময় শেষ হয়ে গেছে। অথচ এলজিইডি কিছুই করেনি। এ কারণে তারা দায় এড়াতে পারে না। এখন এলজিইডি হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আইনি জটিলতায় টেকেরঘাট সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। জটিলতা না কাটলে কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।’