
সরকারি কোনো লাইসেন্স নেই। ট্যাক্স-ভ্যাটসহ কোনো ধরনের রাজস্ব দেয় না। এভাবেই মেজবানি মাংস, বিরিয়ানি ও ইফতার সামগ্রীর জমজমাট ব্যবসা চলছে চট্টগ্রামে। রমজান মাসকে কেন্দ্র করে অবৈধ এইসব ব্যবসার কারণে বৈধ হোটেল রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। সরকারি জায়গা দখল করে এবং প্যান্ডেল, ত্রিপল টাঙিয়ে দেদার চলছে এই ব্যবসা। কিন্তু দেখার কেউ নেই।
জানা গেছে, বৈধভাবে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে হলে জেলা প্রশাসনের অনুমতির পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ কমপক্ষে ১২টি প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নিতে হয়। দিতে হয় আয়কর ও ভ্যাট। অস্থায়ী ব্যবসার ক্ষেত্রেও সিটি করপোরেশনকে রাজস্ব পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা এসব ব্যবসার কোনো লাইসেন্স নেই। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে এই অবৈধ ব্যবসা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হলের মাঠে আবুল বাবুর্চির ইফতারির নামে ব্যবসা পরিচালনা করছেন এই কনভেনশন হলের মালিক মোহাম্মদ রফিক। সিআরবির রেলওয়ের জায়গা দখল করে বিরিয়ানির ব্যবসা করছেন মোহাম্মদ সুমন। সিডিএ মার্কেট ২ নম্বর গেটে নালার পাশে মেজবানের মাংস ও বিরিয়ানি বিক্রি করছেন মো. এরফানুল আলম। অলংকার এলাকায় শাহ ওরস বিরিয়ানির ব্যবসা করছেন তারেকুল হক। এভাবে চট্টগ্রামের লাভলেইনে ওরস বিরিয়ানি, কর্ণফুলী মইজ্জ্যার টেক এলাকায় আকাশ বিরিয়ানি, পতেঙ্গায় ওরস বিরিয়ানির নামে অবৈধ ব্যবসা এখন জমজমাট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাজীর দেউড়ি ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হলের মাঠে আবুল বাবুর্চির নামে ইফতারির ব্যবসা করছে হল কর্তৃপক্ষ। দৈনিক দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি হলেও সরকারকে এক টাকাও রাজস্ব দেয় না। মেজবানি, বিরিয়ানি, হালিম থেকে শুরু করে দুই শতাধিক আইটেমের ইফতারের এই বাজারে মানুষের ভিড়। দুপুর ১টা থেকে এখানে শুরু হয় বিক্রি।
মোহাম্মদ রফিক খবরের কাগজকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে জানিয়ে ইফতার ব্যবসা করছি। রেস্তোরাঁ ব্যবসায় বিক্রির ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। অস্থায়ী ব্যবসা করলেও সিটি করপোরেশনকে রাজস্ব দিতে হয়। ডিসির অনুমতি লাগে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কনভেনশন হল থেকে ভ্যাট এবং আয়কর দেওয়া হয়।’
এতে অন্য বৈধ হোটেল রেস্তোরাঁর ক্ষতি করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্য ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে কেন। ব্যবসা সবাই করছেন। এখানে কম দামে পাচ্ছেন বিধায় ক্রেতারা এখানে আসেন। অন্যদের ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি আমার দেখে লাভ কী।’
চট্টগ্রামের সিআরবি রেলওয়ের জায়গা দখল করে খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে অনলাইনে প্রচার করে ব্যবসা চালু করেছেন মোহাম্মদ সুমন। রেলওয়ের জায়গায় প্যান্ডেল টাঙানো হয়েছে। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন ক্রেতাদের। খোলা আকাশের নিচে জবাই করা হয় গরু। চারদিকে দুর্গন্ধ। শনিবার দুপুরে সেখানে মোহাম্মদ সুমন বলেন, হার্ডওয়্যার ব্যবসা থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে মেজবান ওরস বিরিয়ানির ব্যবসা চালু করেছেন সিআরবিতে। এক মাসের ব্যবসায় অনুমোদন নেওয়ার দরকার কী?
নগরের অলংকার এলাকায় শাহ ওরস বিরিয়ানির মালিক তারেকুল হক বলেন, রমজানে রাতে বেশ কাস্টমার হয়। বিরিয়ানিপ্রেমী মানুষ এখানে আসেন ওরস বিরিয়ানি খেতে।
সিডিএ মার্কেট ২ নম্বর গেটে দেখা যায়, নালার পাশে রান্না করে মেজবানি এবং ওরস বিরিয়ানি বিক্রি করছেন। প্রায় ১০০ ফুট লম্বা কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে নালাকে, যাতে ক্রেতারা দেখতে না পান। কিন্তু দুর্গন্ধ রোধ করা যায়নি।
সেখানে কয়েকজন নারী ক্রেতা পার্সেল বিরিয়ানি নিয়ে মালিককে অভিযোগ করে বলেন, ‘আগেও এখান থেকে পার্সেল নিয়েছি। কিন্তু ভাতের মধ্যে মাংসের দেখা পাইনি। এবার যাতে মাংস বেশি থাকে, এভাবে দেবেন।’ এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. এরফানুল আলম বলেন, ‘এখানে একটি খেলার মাঠ ছিল। নালার কাজের জন্য খেলা বন্ধ রয়েছে। তাই এখানে ব্যবসা শুরু করেছি। অনুমোদন নিইনি কোনো সংস্থা থেকে।’
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যার টেকে বিলের মধ্যে প্যান্ডেল তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে ওরস বিরিয়ানি। সেখানেও রাতে দূর-দূরান্ত থেকে গ্রাহকরা এসে ভিড় করেন।
বিরিয়ানি খেতে আসা মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘সবার দেখাদেখি সেখানে বিরিয়ানি খেতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হলুদ ভাত খেয়েছি মাত্র। ভাতের ভেতরে মাংস দেখিনি। ফেসবুক পেজে বিজ্ঞাপন দেখে মানুষ যাচ্ছেন।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সাব্বির রহমান সানি খবরের কাগজকে বলেন, সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে এই ধরনের ব্যবসা করা অবৈধ। অস্থায়ী ব্যবসা করতে হলেও সিটি করপোরেশকে রাজস্ব দিতে হবে। খতিয়ে দেখে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় করা হবে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এসব অনিয়ম দেখার কথা। কিন্তু ওই সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে মাঠে দেখা যায় না। এ সুযোগে অবৈধ ও অনিরাপদ খাবার ব্যবসা জমজমাটভাবে চলছে।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বাবু বলেন, এসব অবৈধ ব্যবসার কারণে রেস্তোরাঁ মালিকরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অথচ একটি রেস্তোরাঁ থেকে সরকার নানাভাবে রাজস্ব পায়। প্রতিবছর ১০ থেকে ১২টি লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। আয়কর ও ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু অবৈধ এই ব্যবসায়ীরা কিছু দেন না। ব্যবসা করছেন দেদার।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনতাসির মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ বছর হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে অনেকেই বিরিয়ানির ব্যবসা করছেন। আমরা এখনো কোন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাইনি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’