প্রচণ্ড দাবদাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে ফেনীতে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জেলার ছয় উপজেলায় নলকূপ, পুকুর, খাল-বিলসহ কোথাও পর্যাপ্ত পানি নেই। প্রচণ্ড খরতাপে চারদিকে যেন ধু-ধু মরুভূমি। ফলে জেলার বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। টানা কয়েক মাস অনাবৃষ্টির কারণে জেলার ৭০ ভাগ গভীর-অগভীর নলকূপে পানি উঠছে না বলে জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ফেনী জেলায় সরকারি নলকূপের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৮১১টি। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮৭১টি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। চালু থাকা ২৬ হাজার ৯৪১টি নলকূপের তিন ভাগের দুই ভাগেই পানি উঠছে না। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত দুই লক্ষাধিক অগভীর নলকূপেও পানি ওঠে না।
অন্যদিকে সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলা নদীপার্শ্ববর্তী হওয়ায় এসব এলাকার অধিকাংশ টিউবওয়েলে লবণাক্ত পানি উঠছে বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে গতকাল ফুলগাজী উপজেলার জি এম হাট ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের কাজী বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে ১১টি পরিবার বসবাস করে। সেখানে নিজস্ব উদ্যোগে বসানো পাঁচটি টিউবওয়েল রয়েছে। এসব টিউবওয়েলের একটিতেও পানি ওঠে না। এতে খাওয়ার পানির পাশাপাশি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে বাড়ির সদস্যদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
তারা পাশের খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে সেগুলো রান্নার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু ওই বাড়ি নয়, আশপাশের অধিকাংশ বাড়ির নলকূপে পানি ওঠে না। খাবার ও রান্নার পানি তাদের দূর-দূরান্ত থেকে আনতে হয়।
কথা হয় শরীফপুর গ্রামের কাজী বাড়ির বাসিন্দা আবদুল কাদেরের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রীষ্মকাল এলে বাড়ির অধিকাংশ টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। কিন্তু সব কাজের জন্য পানির প্রয়োজন হয়। তখন দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনতে হয়। আমাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
একই বাড়ির সত্তরোর্ধ্ব নারী হাজেরা খাতুন বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছর ধরে গরমের সময় এলেই আমাদের পানির জন্য কষ্ট করতে হয়। অজুর পানিও অন্য জায়গা থেকে আনতে হয়। টিউবওয়েলগুলো নষ্ট। পানি ওঠে না। আধা কিলোমিটার দূরের খালে গিয়ে ওজু-গোসলের পানি আনতে হয়।
একই ইউনিয়নের বসিকপুরের বাসিন্দা আনিস আহমেদ জানান, জিএমহাট ইউনিয়নের শরিফপুর ও শ্রীপুর গ্রামের ৩৫টি গভীর নলকূপের একটিতেও পানি ওঠে না। তাই দূরের জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করতে তাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া বাজারের ব্যবসায়ী নেতা মোস্তফা হোসেন বলেন, বাজারে তিনটি চাপকল ও ১০/১২টি পানি তোলার মোটর রয়েছে। এসব কল ও মোটর থেকে পানি ওঠে না। আশপাশের টিউবওয়েলগুলোরও একই অবস্থা।
এদিকে জেলার পরশুরাম, ছাগলনাইয়াসহ সদর উপজেলায় বিভিন্ন বাড়িতে টিউবওয়েলের পানির সংকটের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে অনেকে পুকুর অথবা ডোবার অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন।
ফেনী সদর উপজেলার রানীরহাট এলাকার কৃষক দিদারুল আলম বলেন, ‘আমাদের জমিতে এবার ধানের চাষ করেছি। কিন্তু পানির অভাবে ধানের থোড় এখন ভুষি হয়ে যাচ্ছে। পুকুর, জলাশয় ও খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি জমিতে বিএডিসির পানি দেওয়ার কথা থাকলেও তারা দিতে পারছে না। তাই আমরা বিপাকে আছি। পানির অভাবে ফসল উৎপাদনে চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
পরশুরামের কৃষক আবু আহাম্মদ বলেন, আমি এবার পাঁচ একর জমিতে ধানের চাষ করেছি। কিন্তু পানি না পাওয়ার কারণে সব ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের নদী, নালা, খাল, বিল সব শুকিয়ে গেছে। কোথাও পানি নেই।’
ফেনী পরিবেশ ক্লাবের সভাপতি নজরুল বিন মাহমুদুল বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে পুকুরের পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। আশপাশের নদী-নালা জলাশয়গুলোতেও পানি কমে গেছে। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। তাই নলকূপে পানি ওঠে না। এতে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল হক জানান, গত পাঁচ মাস অনাবৃষ্টির পাশাপাশি গরমের তীব্রতা বাড়ায় ভূ-গর্ভের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে গভীর নলকূপেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। সংকট কাটিয়ে উঠতে বিকল্প ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করার কথা জানান তিনি।