২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বাগেরহাটের আদালত এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বৈষম্যবিরোধীদের কয়েকজন গুরুতর আহত হন। ওই ঘটনার আট মাস পর গত ৮ এপ্রিল বাগেরহাটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক মো. মিরাজ শেখ ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরও ২০০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এ মামলাকে কেন্দ্র করে বাগেরহাটে বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে।
এদিকে মামলায় দেওয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাগেরহাটের আহ্বায়ক এস এম সাদ্দাদ। তিনি বলেছেন, ‘মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে মামলা করা হলে জুলাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।’
সামিউল নামে মামলার এক সাক্ষী বলেছেন, তিনি কিছুই জানেন না। আগের মামলাটি হালকা করার জন্য এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে মিরাজকে বাদী বানিয়ে একটি পক্ষ মামলা করিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধীদের আরেকটি অংশ প্রশ্ন তুলেছে আহ্বায়কের ভূমিকা নিয়ে। এ মামলার আগে আদালত চত্বরের ঘটনায় আরও দুটি মামলা হয়; যেগুলোর তদন্ত চলছে। তবে সেই মামলা দুটি বৈষম্যবিরোধীদের কেউ করেনি।
মিরাজের করা মামলায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা বাগেরহাট পুরাতন বাজার মোড় থেকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল নিয়ে আদালত এলাকায় আসেন। ১ নম্বর আসামি বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের হুকুমে ২ নম্বর আসামি তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান (৩৮) ও ৪ নম্বর আসামি ইন্সপেক্টর (ডিবি) মো. মাসুদ রানা (৩৫) প্রকাশ্যে তাদের হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে জনসাধারণের ওপর গুলি চালান। ৬ নম্বর আসামি বাগেরহাট সদর থানার তৎকালীন ওসি নিজে মিছিলের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। ২১, ৩১, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আসামি মিছিলে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। ১৫ নম্বর আসামি মিছিলের ওপর প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ করেন। ১ ও ৩ নম্বর আসামি সাবেক এমপি মীর শওকত আলী বাদশা (৬৫) সাধারণ জনতাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য পুলিশকে গুলি-বোমা বর্ষণের নির্দেশ দেন।
এভাবে মামলায় উল্লেখ করা হলেও আহ্বায়ক সাদ্দাম বলেন, ‘ওই দিন বাগেরহাটের ওসিসহ অনেকেই আমাদের সহযোগিতা করেছেন। তারা সহযোগিতা না করলে ওই দিন আমাদের অনেকে শহিদ হয়ে যেতেন। সব মিলিয়ে পুলিশের ভূমিকা আমাদের পক্ষেই ছিল। মামলায় গুলি করেছে, বোমা মেরেছে এসব বিষয় বলা হয়েছে। কিন্তু এরকম কিছু হয়নি। ভুল তথ্য দিয়ে মামলা করা হলে আমাদের সংগঠনেরই বদনাম হয়।’ ঘটনার দিন হামলায় সাদ্দামেরও হাত ভেঙে যায়।
মামলার সাক্ষী সামিউল বলেন, ‘আমাকে সাক্ষী করা হয়েছে। কিন্তু আমি জানি না। আমাকে ছাত্রলীগ কুপিয়ে আহত করে। পুলিশ গিয়ে রক্ষা করে। তা না হলে বাঁচাই যেত না। ৯ জন আমাকে কুপিয়ে জখম করে অথচ সেই ৯ জনের কারও নাম মামলায় নেই।’
বাগেরহাটের কয়েকটি সূত্র জানায়, তৎকালীন দুই পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের বাইরে ওই মামলায় সেই দুই কর্মকর্তার একজনের অনুসারীদের আসামি করা হয়েছে। অন্য কর্মকর্তা বা তার অনুসারী কাউকে আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে মামলার বাদী মিরাজ শেখকে ওই কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খবরের কাগজকে তিনি জানান, ৪ নম্বরে সেই পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। কিন্তু এজাহারে তার নাম নেই। মিরাজকে তা জানালে তিনি বলেন, ৩০ নম্বর আসামি পর্যন্ত একটু খুঁজে দেখেন। তার নাম আছে। কিন্তু ৬৭ নম্বর পর্যন্ত খুঁজেও তার নাম পাওয়া যায়নি। পরে মিরাজ বলেন, হয়তো ভুল হয়েছে। তার নাম দেওয়ার সুযোগ এখনো আছে। কম্পিউটার কম্পোজ যেখানে করেছি, তারা আমাকে যেভাবে পরামর্শ দিয়েছে, সেভাবেই মামলার ড্রাফট করা হয়েছে। তারাই সব লিখে দিয়েছে। তারা বলেছেন, ওই ধরনের বিষয় উল্লেখ না করলে মামলা টিকবে না। আমি এর আগে মামলা করিনি, প্রথম তাই ভুল হতে পারে।’
মামলার বাদী মিরাজ শেখ মামলা-সংক্রান্ত ব্যাপারে একেকবার একেকজনকে একেক রকমের তথ্য দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনি ১০ এপ্রিল ফেসবুক লাইভে এসে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর যে বিষয়টি বলেছেন, খবরের কাগজের কাছে আসা ভিডিওতে সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে তার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জেলা সদস্যসচিব নওরীন। তিনি বলেছেন, ‘ওই ভিডিওটি এডিট করা’।
১০ এপ্রিল লাইভটি শেয়ার করে নওরীন লিখেছেন, ‘জেলার আহ্বায়ক যখন নিজেই আওয়ামীপন্থি হয়ে মামলাবাণিজ্য চালায়।’
এরপর এ ঘটনায় রাতে বাগেরহাট সদর মডেল থানায় মিরাজ সাধারণ ডায়েরি করেন। পরদিন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও আহ্বায়কের বিরুদ্ধে মিথ্যা বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহ্বায়ক এস এম সাদ্দাম মিরাজকে বহিষ্কার করেন। বহিষ্কার নোটিশে মিরাজকে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ‘সদস্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এই নোটিশটি ফেসবুকে পোস্ট করে নওরীন লিখেছেন, ‘যে আহ্বায়ক জানেনই না তার কমিটির লোক কোন পদে আছেন; সদস্য না সংগঠক? যে আহ্বায়কের নামে এত বড় একটা অভিযোগ এল, জিডি পর্যন্ত হলো। তার সঠিক তদন্ত না হয়ে সেই আহ্বায়ক একক ক্ষমতা বলে কীভাবে একজন সংগঠককে বহিষ্কার করেন? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের কমিটিকে একটি সার্কাস গ্রুপে পরিণত করা হয়েছে। বারংবার সেন্ট্রালের দৃষ্টিআকর্ষণ করেও এই আহ্বায়কের বিরুদ্ধে, অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো ধরনের তদন্ত হয়নি।’
তবে নওরীনের ৫ আগস্টের আগের আন্দোলনে সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলেছেন, নওরীনের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে জুলাই আন্দোলনে তার দৃশ্যমান কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। নওরীনের ফেসবুক ঘেঁটেও ৩১ জুলাই পর্যন্ত তেমন কোনো পোস্ট পাওয়া যায়নি বা ৫ আগস্ট পর্যন্ত তার কোনো ছবিও দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে মিছিলের সামনে তাকে দেখা গেছে। জেলা আহ্বায়ক সাদ্দাম বলেন, ‘কোথাও নওরীনকে (সদস্যসচিব) দেখিনি। আর কে দেখেছে তাকেও এ পর্যন্ত খুঁজেও পাওয়া যায়নি। আমাকে নওরীন কয়েকবার বলেছেন, আপনি অন্তত বলবেন আপনি আমাকে আন্দোলনে দেখেছেন।’
এ বিষয়ে নওরীন বলেন, ‘৫ তারিখের আগে দেয়াল লিখনের ফান্ডিং থেকে সব আমি করেছি। রিফর্ম বাংলাদেশ নামে একটা গ্রুপ করা হয়। সেই গ্রুপটির অ্যাডমিন আমি। ৪ তারিখ আমি ছিলাম না। তবে ছিলাম না বললে ভুল হবে। আমি ছিলাম। যারা আন্দোলন করছিল তাদের জন্য যে দোকান থেকে পানি কিনে নিয়েছি, যে দোকানে পানি রাখছি, মারামারি শুরুর সময় আমি যে দোকানে লুকিয়েছিলাম তারা সাক্ষী দেবেন। ৪ তারিখে আন্দোলন করছিল জামায়াত-শিবিরের লোকজন। ফেসবুক খুলে দেখে আমি সেখানে যাই। আমাকে দেখে বলছিল, ধর ধর ওমুকের নাতি, তখন আমি পালিয়ে একটা দোকানে আশ্রয় নিই। সেই দোকানদারও সাক্ষী দেবেন। সাংবাদিকদের ক্যামেরা ফুটেজে আমি নেই। আমি গেছি আন্দোলন করতে। ছবি তুলতে তো যাইনি। প্রেসক্লাবেও আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সে জন্য আমি আমার সাক্ষী রেডি করে রাখছি। এরকম প্রশ্ন করলে আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তোলা হবে।’