
সময়মতো দরপত্র আহ্বান ও অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (খুমেক) ৭৭ ধরনের জরুরি ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা নিতে এসে ওষুধ না পেয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তাদের বাইরের ফার্মেসি থেকে উচ্চমূল্যে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। এরই মধ্যে ৪৫ ধরনের ওষুধের মজুতও শেষের পথে।
সেবাপ্রত্যাশীরা বলছেন, বাইরে থেকে বেশি দামে ওষুধ কিনতে হলে হাসপাতালে এসে লাভ কী? অনেকের অভিযোগ, সরবরাহ করা ওষুধও অনেক সময় বাইরে থেকে কিনতে বাধ্য করা হয়। তারা এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সময়ে হাসপাতালের অনেক পরিচালক স্বল্প সময়ের মধ্যে বদলি ও অবসরে গেছেন। তাই যথাসময়ে ওষুধের দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে সব ধরনের ওষুধের সরবরাহ থাকবে।
খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন স্টোরকিপার অশোক কুমার হালদার জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতি অর্থবছরে নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রায় ১২২ ধরনের ওষুধ সংগ্রহ করে। ওই ওষুধ রোগীদের মধ্যে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর খুমেক হাসপাতালে পরপর কয়েকজন পরিচালকের বদলি ও অবসরজনিত কারণে সময়মতো দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। ফলে হাসপাতালের মেডিসিন স্টোরে প্রায় ৭৭ ধরনের ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। বাকি ৪৫ ধরনের ওষুধের মজুতও শেষের পথে।
জানা যায়, হাসপাতাল থেকে প্রায় সব ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহের কথা থাকলেও বর্তমানে ২২ ধরনের ট্যাবলেট, চার ধরনের ক্যাপসুল, ৩৫ ধরনের ইনজেকশন, নরমাল স্যালাইন, ১৩ ধরনের চোখের ড্রপ ও অন্যান্য তিন ধরনের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে জীবনরক্ষাকারী ও অধিক প্রয়োজনীয় ওষুধও রয়েছে। ফলে এসব ওষুধ রোগীদের অতিরিক্ত দামে বাইরের ফার্মেসি থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
মেডিসিন স্টোর জানিয়েছে, হাসপাতালে ট্যাবলেট এসিক্লোফেনাক ১০০ মিলিগ্রাম, অ্যামলোডিপিন ৫ মিলিগ্রাম, অ্যাটেনোলল ৫০ মিলিগ্রাম, অ্যাসপিরিন ৭৫ মিলিগ্রাম, ক্যাপসুল অ্যামোক্সিসিলিন ৫০০ মিলিগ্রাম, ডক্সিসাইক্লিন ১০০ মিলিগ্রাম, ইনজেকশন অ্যাড্রিনালিন ১ মিলিগ্রাম, অ্যামিকাসিন ১০০ মিলিগ্রাম, নরমাল স্যালাইন ১০০০ মিলিগ্রাম, চোখের ড্রপ কার্বক্সিমিথাইল সোডিয়াম ১%, ডমপেরিডন ৫ মিলিগ্রামসহ ৭৭ ধরনের ওষুধের সরবরাহ নেই। ফলে ওয়ার্ডগুলো থেকে এসব ওষুধের চাহিদা দিলেও তা সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
ইয়াসিন হাওলাদার (৪২) নামে হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক রোগী বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে এখানে ভর্তি আছি। কয়েকটি গ্যাসের বড়ি ছাড়া এখান থেকে আর কোনো ওষুধ দেয়নি। সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়।’
মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা লাকি বেগমও বললেন একই কথা। হাসপাতালের সবকিছু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় জানিয়ে ৩৮ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘হাজার হাজার টাকা খরচ করে যদি বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয়, তা হলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে লাভ কী। এখানে প্রতি পদে পদে সিন্ডিকেট। রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ কেনা, সবকিছুই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করতে হয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে যখন জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ঘাটতি রয়েছে, ঠিক এই সময় প্রায় ১৪ লাখ টাকার ‘অপ্রয়োজনীয়’ ওষুধ ও ট্যাবলেট মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ওই আট ওষুধের তালিকা করে। স্বল্পমেয়াদি ওই ওষুধগুলো হলো- ফেনোবারবিটাল ৬০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট, মিডাজোলাম হাইড্রোক্লোরাইড ১৫ মিলিগ্রাম ইনজেকশন, জেনটমাইসিন ২ মিলিগ্রাম ইনজেকশন, জি-এড্রোনালিন ও কলেরা স্যালাইন ৫০০ মিলিগ্রাম ইনজেকশন।
হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মোস্তফা কামাল বলেন, হার্টের চিকিৎসায় কার্যকরী ইনজেকশন এনোক্সাপারিন ৬০ মিলিগ্রাম ও ৮০ মিলিগ্রামের চাহিদা দেওয়া হলেও প্রতিবছর ৪০ মিলিগ্রামের ইনজেকশন কেনা হয়। গত বছরের কেনা প্রায় সাড়ে ৭০০ এনোক্সাপারিন ৪০ মিলিগ্রামের দামি ইনজেকশন স্টোরে পড়ে আছে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে হাসপাতালে সরবরাহ থাকলেও সেই ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে রোগীকে বাধ্য করা হয়। এতে রোগীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহসীন আলী ফরাজী বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী অস্থিতিশীল অবস্থায় হাসপাতালের কয়েকজন পরিচালক পরপর বদলি ও অবসরে গেছেন। এ কারণে তারা সময়মতো ওষুধ কিনতে দরপত্র আহ্বান করতে পারেননি। তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু করছি। বর্তমানে ওগুলো মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে। অর্থ বরাদ্দসাপেক্ষে আগামী দুই মাসের মধ্যে সব ধরনের ওষুধ সংগ্রহ করা যাবে। তখন রোগীদের আর কোনো সমস্যা হবে না।’