
রমজান মাসে বেড়ে গেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। পোশাক, ওষুধ থেকে শুরু করে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যে চলছে ক্রেতা ঠকানোর মহোৎসব। ভোক্তা অধিকার, জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের অভিযানেও মিলছে কারসাজির প্রমাণ। বার বার সতর্কের পরও শুধরাচ্ছে না তারা। ফলে বরাবরেই মতোই প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
নগরীর চাক্তাইয়ের রাজাখাল এলাকায় প্রতিবছর ঈদ ঘনিয়ে এলে সেমাই তৈরির ধুম পড়ে। বেনামি এসব সেমাই বাজারে বিক্রি হয় দেদার। অথচ এসব সেমাই তৈরি হচ্ছে নোংরা পরিবেশে। সেমাইয়ের ওপর তেলাপোকা মাছিসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের অবাধ বিচরণ, সেমাই তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে নোংরা পানি। পাশাপাশি খোলা পরিবেশে শুকানোর কারণে ধুলাবালু ও অক্ষতিকর কার্বনযুক্ত ছাই সেমাইয়ের সঙ্গে মিশছে। গত মঙ্গলবার ভোক্তা অধিকারের অভিযানে তিনজনকে জরিমানা করা হয়। এরপরও শুধরাননি এসব ব্যবসায়ী। গত বুধবার জেলা প্রশাসন অভিযানে গেলে একই চিত্র ধরা পড়ে। এ সময় দুই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। এরপরও থেমে নেই এসব অস্বাস্থ্যকর সেমাই তৈরি।
এদিকে মানুষ সেলিম পাঞ্জাবি, পরিস্থান ও মেগা মার্ট শপিংমলের মতো নামিদামি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখেন। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান দেশি পোশাককে বিদেশি বলে বিক্রি করে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে। নগরের বিয়াজউদ্দিন বাজারে সেলিম পাঞ্জাবি মিউজিয়াম নামে প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় ভাউচার না রেখে বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পাঞ্জাবিতে ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবির ট্যাগ লাগিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। একই এলাকার পরিস্থান নামে প্রতিষ্ঠানেও চলছে সমান কারসাজি। ভোক্তা অধিকারের অভিযানে এসব নামিদামি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা ধরা পড়ে। তবে এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান বাড়তি অর্থ আদায় করে ভোক্তাদের নিয়মিত ঠকিয়ে গেলেও রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে উঠেছে ওরিয়েন্ট রেস্টুরেন্ট। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই এখানে ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। এই রেস্টুরেন্টটিকে আগেও সতর্ক করেছিলেন ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা। এরপরও বদলায়নি কিছু। প্রতিষ্ঠানটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ইফতার এবং খাদ্যসামগ্রী তৈরি করছে। পাশাপাশি খাবারে তেলাপোকার অবাধ বিচরণ দেখা গেছে।
এদিকে তিন মাসের বেশি সময় ধরে নগরে উধাও হয়ে যায় বোতলজাত ভোজ্যতেল। মিলাররা ঠিকঠাক বাজারজাত করলেও বিভিন্ন খুচরা বিক্রেতা ও ডিলারদের মজুতের কারণে ভোজ্যতেলে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। এতে করে কোথাও দুই-একটি বোতলজাত সয়াবিন মিললেও ১৭৫ টাকার স্থলে বিক্রি হয়েছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়।
অন্যদিকে খোলা তেলের ওপর চাপ পড়লে ব্যবসায়ীরা সেটিরও দাম বাড়িয়ে লিটারপ্রতি বিক্রি করেন ১৯৫ টাকায়। এমন পরিস্থিতিতে গত ৪ মার্চ জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা মানেননি খুচরা ব্যবসায়ীরা। এখনো খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৮০ টাকায়। অন্যদিকে একজন ক্রেতা দুই লিটার তেল ৩৫০ টাকার বদলে কিনছেন ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়। সিটি করপোরেশন বা জেলা প্রশাসনের দফায় দফায় অভিযানও দমাতে পারেনি এসব অসাধু ব্যবসায়ীকে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘রমজান মাস শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে বাজার তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত ছিল। তার ওপর রমজানের মধ্যে কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা চলে আসেন। মূল সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। এটা না করার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল, ভেজাল পণ্য প্রস্তুত ও বাজারজাত করার সুযোগ পাচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাদের জরিমানা করলে হবে না। জেল দিতে হবে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘রমজান মাস এলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন অভিযানে আমরা দেশি পোশাককে বিদেশি বলে বাড়তি দরে বিক্রি, খাবারে ক্ষতিকর রং কেমিক্যাল ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর রান্নাঘর যেখানে তেলাপোকার অবাধ বিচরণ, এমনকি ফার্মেসিগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার প্রমাণ পেয়েছি। বিষয়গুলো খুবই উদ্বেগের। সতর্ক করার পর কেউ শুধরাচ্ছে, আবার কেউ শুধরাচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হব।’