নড়াইলে শুরু হয়েছে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাসব্যাপী নিশিনাথতলার বৈশাখী পূজা। মনোবাসনা পূরণের জন্য এই মাসের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সেখানে চলে পূজা-অর্চনা। শ্রী শ্রী নিশিনাথতলা মন্দির কমিটির আয়োজনে শেষের দিকে চলে সপ্তাহব্যাপী মহানামযজ্ঞ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নড়াইল শহর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে একটি বটগাছকে (বাবা নিশিনাথের বটগাছ) কেন্দ্র করে নামকরণ করা হয় নিশিনাথতলা। এই বটতলায় পূজারিদের ভিড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মেলার নামকরণ হয়েছে ‘নিশিনাথতলার বৈশাখী পূজা’। তবে তারও অনেক আগে থেকে এই বটগাছ ও নিশিনাথের মন্দিরে পূজা-অর্চনা শুরু হয়। এর সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ‘নিশিনাথ’ সনাতন ধর্মের একজন প্রতিষ্ঠিত দেবতা। নিশিনাথের আরেক নাম শিব। এই দেবতার পূজা ও ধ্যানের কথা পুরাতন সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থে পাওয়া যায়।
জনশ্রুতি রয়েছে, অনেকেই বাবা নিশিনাথ ঠাকুরকে গভীর রাতে ওই গাছ থেকে নেমে খড়ম পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পাশের চিত্রা নদীর ঘাটে স্নান করতে দেখেছেন। শুরুতে নিশিনাথতলার এই জায়গাটি ইংরেজ আমলে জমিদারদের দখলে ছিল। এই জায়গার অলৌকিকত্ব অনুভব করে জমিদাররা প্রায় ৩০০ বছর আগে নিশিনাথ ঠাকুরের নামে নড়াইল-নোয়াপাড়া সড়কের পাশে ওই বটগাছ তলায় একটি মন্দির তৈরি করে দেন। বিশাল এই বটগাছে দেবতা ‘নিশিনাথ ঠাকুর’ বসবাস করেন বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আজও বিশ্বাস করেন।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের মনোবাসনা পূরণের জন্য নারী-পুরুষ সবাই জল, দুধ, তেল, সিঁদুর দিয়ে পূজা করে থাকেন। একসময় অনেকে মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে গাছের ডালে ছোট-বড় ইট বেঁধে রেখে যেতেন। মনোবাসনা পূর্ণ হলে তারা ফিরে এসে সেই ইট খুলে দেবতা নিশিনাথ ঠাকুরের নামে মন্দিরে সাধ্যমতো পূজা দিয়ে যেতেন। তবে বর্তমানে গাছটির তেমন ডালপালা না থাকায় ইটের টুকরো বাঁধা তেমন দেখা যায় না।
জানা গেছে, নড়াইলবাসীর কাছে বৈশাখ মানেই নিশিনাথতলায় এসে চিত্রা নদীর বাঁধাঘাট থেকে খালি পায়ে জল এসে ঢালা। নিজেকে পবিত্র করে দুধ-ফুল, তেল দিয়ে পূজা করা, প্রসাদ বিতরণ করা।
এদিকে নিশিনাথতলার বৈশাখী মেলা চলে আসছে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে। দেশের মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন এই মেলা। মেলাটি সনাতন ধর্মকে কেন্দ্র করে হলেও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ এই মেলায় ছুটে আসে প্রতিবছর।
ভক্ত শুক্লা সাহা বলেন, ‘নিশিনাথতলায় আমরা ছোটবেলা থেকেই প্রতিবছরের বৈশাখ মাসের শনি ও মঙ্গলবার পূজা করে থাকি।’ সুজিত সাহা নামে আরেক পূজারি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, নিশিনাথতলায় কোনো কিছু চাইলে সেটা পূরণ হয়।’
অনিতা বিশ্বাস বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও নিশিনাথতলায় অনেক বড় মেলা বসত। সেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দোকানিরা আসত তাদের পসরা নিয়ে। বৈশাখ মাসজুড়ে চলত সার্কাস, পুতুলনাচসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এখন তেমন কিছুই হয় না।’
নিশিনাথতলা পূজা মণ্ডপের পুরোহিত সুনীল চক্রবর্তী বলেন, ‘কত বছর ধরে নিশিনাথতলায় পূজা-অর্চনা হচ্ছে, সেটার সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে আমরা শুনছি, ৩০০ বছরের কম নয়।’
নড়াইল নিশিনাথতলা কমিটির সভাপতি অচিন চক্রবর্তী বলেন, ‘৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে বৈশাখ মাসের প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার নদী থেকে জল এনে গাছে ঢালা, পূজা-অর্চনা করে থাকেন ভক্তরা। পূজারি ভক্তদের বিশ্বাস, নিশিনাথতলায় এসে কিছু চাইলে কেউ খালি হাতে ফেরেন না।’