চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ১৪ বছর বয়সী এক মাদ্রাসাছাত্রীকে জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তারই মা ও সৎবাবার বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে প্রতিকার চেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার ওই মাদ্রাসাছাত্রী বাদী হয়ে তার মা, সৎবাবা ও তিন প্রতিবেশীকে বিবাদী করে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
বিবাদী ওই তিন প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।
বাল্যবিবাহের শিকার ওই মাদ্রাসাছাত্রী উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের পূর্ব মাহালিয়া গ্রামের চিতামুড়া এলাকার মৃত আবু নৈয়মের মেয়ে। এ ছাড়াও সে বাজালিয়া হেদায়েতুল ইসলাম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।
বিবাদীরা হলেন- ভুক্তভোগীর মা মিনু আক্তার (৩৫), সৎবাবা নুরুল ইসলাম (৪৫), প্রতিবেশী আবদুর রশিদ (৫০), আবদুর রশিদের স্ত্রী হালিমা বেগম (৪৫) ও তাদের ছেলে মোহাম্মদ রাকিব। তারা প্রত্যেকে উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের পূর্ব মাহালিয়া গ্রামের চিতামুড়া এলাকার বাসিন্দা।
অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী ভুক্তভোগী মাদ্রাসাছাত্রীর বয়স এখনো ১৪ বছর। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তার সঙ্গে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে স্থানীয় জাবেদ নামে এক যুবকের বিয়ের আয়োজন করেন মা মিনু আক্তার ও সৎবাবা নুরুল ইসলাম। মেয়েটি এ বিয়েতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও উভয় পরিবারের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় যে, বিয়ে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী দুই মাস পর্যন্ত ওই মাদ্রাসাছাত্রী নিজের বাড়িতেই অবস্থান করবেন এবং দুই মাস পূর্ণ হলে তাকে সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হবে। তারই প্রেক্ষিতে কোনো ধরনের পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়াই এক প্রকার গোপনে কাজির মাধ্যমে বিবাহ রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন দুই পরিবারের কর্তারা। বিবাহ রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হওয়ার পর পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই মাদ্রাসাছাত্রী নিজ বাড়িতেই অবস্থান করেন। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর ওই মাদ্রাসাছাত্রী হঠাৎ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে পারভীন আক্তার নামে তার এক নিকটাত্মীয়ের চট্টগ্রামস্থ বাসায় আশ্রয় নেয়। পরে তার পরিবারের সদস্যরা সেখান থেকে তাকে জোরপূর্বক বাড়িতে নিয়ে আসেন।
বাড়িতে ফিরে আসার কিছুদিন পর তাকে মারধর করে জোরপূর্বক শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর চেষ্টা করেন তার মা ও সৎবাবা। এ ঘটনার কয়েক দিন পর সে পুনরায় বাড়ি থেকে পালিয়ে তার খালু জাহাঙ্গীর আলমের কাছ থেকে তার আরেক নিকটাত্মীয় মনোয়ারা বেগমের চট্টগ্রামস্থ বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে সেখানে আশ্রয় নেন। এ ঘটনায় তার মা সাতকানিয়া থানায় একটি অভিযোগ করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরে ওই ছাত্রী তার মা ও সৎবাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে নিজেই থানায় হাজির হন। পরে সাতকানিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) খাইরুল হাসান ভুক্তভোগী ও তার মা, সৎবাবা এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সালিশী বৈঠকের আয়োজন করেন। ওই সালিশী বৈঠকে ভুক্তভোগী ছাত্রী বিবাহের সম্পর্কটি ছিন্ন করে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করবেন বলে জানান। পরে তার মা ও সৎবাবা মেয়েকে ছাড়াই বাড়িতে ফিরে যান। এর পর থেকে ওই মাদ্রাসাছাত্রী তার প্রতিবেশী ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় এ্যানি আকতারের বাড়িতে অবস্থান করছেন।
বাল্যবিবাহের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী বলে, আমার বয়স এখনো ১৪ বছর। আমি বাজালিয়া হেদায়েতুল ইসলাম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। আমার ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরব। কিন্তু আমার মা ও সৎবাবা মিলে আমাকে জোরপূর্বক বিবাহ দিয়েছে। আমাকে মারধর করে বিবাহ রেজিস্ট্রিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছেন। এর পর আমি পালিয়ে গিয়ে আমার এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেই। এখনো আমার মা ও সৎবাবা আমাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই আমি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছি।
প্রতিবেশী ও দূরসম্পর্কের আত্মীয় এ্যানি আকতার বলেন, সে একদিকে আমার প্রতিবেশী অন্যদিকে দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। তাকে বাল্যবিবাহ দেওয়াতে সে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় চলে গিয়েছিল। পরে সাতকানিয়া থানায় সালিশী বৈঠকে সে জানায়, সে এ বিবাহের সম্পর্কটি ছিন্ন করে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করবে এবং মা ও সৎবাবার সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করবে। কিন্তু তার মা ও সৎবাবা তাকে বাড়িতে নেয়নি। সে থেকে মেয়েটি আমার বাড়িতে রয়েছে।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত ওই মাদ্রাসাছাত্রীর মা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। পরে সৎবাবা নুরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বাল্যবিবাহের বিষয়টি শিকার করে তিনি বলেন, মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিক্রি করে দিয়েছি। মেয়ের জামাইকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দেওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকার ফার্নিচার তৈরি করেছি। পরে সে হঠাৎ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তাকে আমরা অনেক দিন খোঁজাখুঁজির পরে বাড়িতে নিয়ে আসি। পরে সিদ্ধান্ত হয় কাজির কাছে গিয়ে বিয়ের সম্পর্কটি ছিন্ন করা হবে। এর কিছুদিন পর মেয়েটি পুনরায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। আমি যেহেতু সৎবাবা এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নাই। আমি ওই মেয়েকে আর বাড়িতে তুলব না। তার মা যদি তাকে লালনপালন করতে পারে তাকে বাড়িতে নেবে, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
সাতকানিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) খাইরুল হাসান বলেন, এ ঘটনায় একটি সালিশী বৈঠকে বসেছিলাম। ওই সালিশী বৈঠকে বাল্যবিবাহের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী বিবাহের সম্পর্কটি ছিন্ন করে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করবে বলে জানায়। পরে আমরা তাদেরকে আইনি পরামর্শ দিয়েছিলাম। এ ছাড়াও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার জন্য বলেছি।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস খবরের কাগজকে বলেন, এক মাদ্রাসাছাত্রীকে জোরপূর্বক বাল্যবিবাহ দেওয়ার ঘটনায় ওই মাদ্রাসাছাত্রী বাদী হয়ে আমার কাছে একটি অভিযোগ করেছে। এ ঘটনায় তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরিফুল/মেহেদী/