
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়নি দেশের বৃহত্তম দুই উপজেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু। ফলে যোগাযোগব্যবস্থার ঘাটতির কারণে পাহাড়ি জনপদের মানুষরা নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ নানিয়ারচর-লংগদু আঞ্চলিক সড়কের মাত্র ২৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ হলেই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পাঁচ উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। খুলে যাবে সমৃদ্ধির নতুন দুয়ার। কৃষিপণ্য বিপণন ও পর্যটনে তৈরি হবে গুরুত্বপূর্ণ হাব। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার পাশাপাশি বছরে বাণিজ্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার। এরই মধ্যে জনগুরুত্ব বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে রাঙামাটি সড়ক বিভাগ। তাই সড়কটি দ্রুত নির্মাণে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা।
জানা গেছে, বিশেষ ভৌগলিক অবস্থার কারণে পাহাড়ের সব উপজেলা এখনো জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় আসেনি। এর সঙ্গে গত শতকের ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ হলে কৃত্রিম হ্রদের কারণে দূরবর্তী বেশ কয়টি উপজেলার মতো নানিয়ারচর, লংগদু ও বাঘাইছড়িও পানিবন্দি হয়ে জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেখানে যোগাযোগব্যবস্থায় নৌযান একমাত্র ভরসা হওয়ায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের পরিবহন ও বাজারজাত করা যেমন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, তেমনি যাতায়াতেও সৃষ্টি হয় নানান ভোগান্তি। তবে ২০২০ সালে নানিয়ারচরের চেঙ্গী নদীতে ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণের পর পাহাড়ে সমৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়।
এদিকে ৩৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বগাছড়ি-নানিয়ারচর-লংগদু আঞ্চলিক সড়কটির সাড়ে ১৩ কিলোমিটার অংশ আগে থেকেই পাকা ছিল। অবশিষ্ট ২৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ হলেই জেলা সদরের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। এতে রাঙামাটির নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা এই পাঁচ জেলা-উপজেলার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ সড়কটি ব্যবহার করতে পারবেন। এই সড়ক ধরে পাহাড়ি জনপদে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতে খরচ ও সময় সাশ্রয়সহ কৃষি অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। আর সড়ক যোগাযোগ, পর্যটন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
সম্প্রতি নানিয়ারচরের বড়পুলপাড়ায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হলে এসব চিত্র ফুটে উঠে। গ্রামটির বাসিন্দা পলেন চাকমা বলেন, ‘এ সড়কটিতে প্রয়োজনীয় সব কয়টি সেতুই আছে। এখন দরকার সড়ক নির্মাণ। সড়ক হলে লংগদু থেকে নানিয়ারচরে যাতায়াতে সবকিছুতেই সুবিধা হবে। গ্রামবাসী কৃষিপণ্য খুব সহজে বাজারে নিতে পারবে। দামও ভালো পাবে।’
পলাশ চাকমা নামে ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের এদিকে আনারস, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল ও সবজির চাষ হয়। এই রাস্তাটি হলে আমাদের মালামাল পরিবহনে সময় ও খরচ দুই-তৃতীয়ংশই বেচে যাবে।’
স্থানীয় পূর্ণিমা চাকমা বলেন, ‘রাস্তাটি ভালো হলে সবারই সুবিধা হতো। এখন যাতায়াতে বেশি কষ্ট। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও জরুরি রোগীর যাতায়াতে খুবই অসুবিধা হয়। বর্ষাকালে তো পা ফেলাই যায় না।’
সুধাকর চাকমা নামে একজন বলেন, ‘নানিয়ারচর থেকে লংগদু সড়কটি নির্মাণ হলে লংগদু, বাঘাইছড়ির মানুষদের খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ঘুরে রাঙামাটি যাওয়া লাগবে না। তখন তারা দ্রুত রাঙামাটি যাতায়াত করতে পারবে। যাতায়াত এখন তিন দিন লাগলেও সড়ক হলে লাগবে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা।’
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মিনহাজ মুরশীদ বলেন, ‘প্রস্তাবিত এ সড়কটি পাহাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি।
নানিয়ারচরের বড়পুল থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলে লংগদু হবে কৃষিপণ্য বিপণন ও পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ হাব। এতে বছরে বাণিজ্য হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্যও কাজে আসবে। পর্যটকরাও সাজেক থেকে লংগদু-রাঙামাটি-বান্দরবান হয়ে স্বল্প সময় ও খরচে কক্সবাজার যেতে পারবেন। তাই সড়কটি দ্রুত নির্মাণে বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপ চাই।’
রাঙামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, ‘মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই পথটি সচল হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমরা একটি ডিও লেটার পেয়েছি। জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সড়কটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছি। যেন ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। সড়কটি নির্মিত হলে রাঙামাটি জেলার সঙ্গে লংগদু-বাঘাইছড়ি উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। পর্যটন এলাকা সাজেকের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।’