
‘ছোটবেলা থেকে নদীভাঙন দেখে আসছি। আমাদের ঘর কতবার ভেঙেছে, হিসাব নেই। এখন আর কোথায় যাব? জায়গা নেই, জমি নেই। সরকার যদি কিছু করে, তা হলে আমাদের একটু শান্তি হয়।’ লোহালিয়া নদীর ভাঙনের ভয়াবহতা বোঝাতে কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের ৬৫ বছর বয়সী বেগম জিবন্নেছা।
স্থানীয়রা জানান, এক শতাব্দী ধরে বারবার ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে শত শত পরিবার। গত ১০০ বছরে অনেক পরিবারকে কমপক্ষে পাঁচ থেকে দশবার বসতবাড়ি স্থানান্তর করতে হয়েছে। ফলে শুধু দারিদ্র্যই নয়, বাড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক দূরত্ব। এর প্রভাব পড়েছে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে।
এবার শুষ্ক মৌসুমেও নদীভাঙনের শিকার হয়ে অন্তত ১০টি পরিবার বসতি হারিয়েছে। বর্ষা মৌসুম এলে এ দুর্ভোগ আরও তীব্র হয়। ২০০৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরে এই বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রাণ হারিয়েছিলেন একই পরিবারের চারজনসহ ছয়জন। আজও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন এ এলাকার হাজারো মানুষ। যেকোনো সময় আবারও বাঁধটি ভেঙে কেড়ে নিতে পারে প্রাণ। নদীভাঙনের শিকার এই চারটি গ্রামের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। যদি বেড়িবাঁধটি ভেঙে যায়, তা হলে রবিশস্য এবং মৌসুমি ফসলের ভয়াবহ ক্ষতি হবে। এতে শুধু কৃষকরাই নয়, পুরো এলাকার অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। পাশাপাশি নারী ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, স্বাভাবিক বিকাশ এবং শিক্ষায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মরিয়ম ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবার নদী ভাঙলে আমাদের ঘরবাড়ি নদীতে ভেসে যায়। স্কুলেও যেতে পারি না। আমাদের নতুন জায়গায় যেতে হয়, নতুন স্কুলে ভর্তি হতে হয়। অনেক কষ্ট হয়।’
কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে নদীভাঙন রোধের জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। নানা প্রতিশ্রুতি মিলেছে। কিন্তু এখনো টেকসই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘নদীভাঙনের কারণে এই জনপদ ভয়াবহ আর্থিক, সামাজিক ও মানবিক সংকটের সম্মুখীন হতে পারে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে শত শত পরিবার চরম দুর্দশায় পড়বে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণই হতে পারে এ সমস্যার একমাত্র সমাধান।’
এ বিষয়ে পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন বলেন, ‘নদীভাঙন রোধে আমরা জরুরি কিছু উদ্যোগ নিতে পারি। তবে টেকসই সমাধানের জন্য বড় প্রকল্পের প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া গেলে স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করা সম্ভব।’