ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় বিনামূল্যে প্রনোদনার বীজ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। নিম্নমান ও পরিমাণে কম বীজ দিয়ে বরাদ্দ আত্মসাতের ঘটনায় উপজেলার তিন কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। ঘটনা তদন্ত করছে কৃষি বিভাগ। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাদিয়া ফেরদৌসি।
ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৭ হাজার ৮৬০ জন কৃষকদের বিভিন্ন বীজ দেওয়ার কথা ছিল। তাদের মধ্যে যারা বীজ পেয়েছেন, তাদের অনেকে নিম্নমানের বীজ পেয়েছেন। পরিমাণেও পেয়েছেন কম। নিম্নমানের বীজ রোপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক কৃষক। বরাদ্দ অনুযায়ী প্রতি কৃষকের ৬০০ টাকা প্যাকেজ বীজের মূল্য ধরা থাকলেও ইস্পাহানি এগ্রো লিমিটেড থেকে ৩২০ টাকায় নিম্নমানের প্যাকেজ বীজ কেনা হয়েছে। মূলত সরকারি টাকা আত্মসাৎ করার জন্য কম টাকায় নিম্নমানের বীজ কিনে বিতরণ করা হয়েছে।
আরও জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা কৃষি অফিসার নামের একাউন্টের ১৩টি চেকে ইস্পাহানির প্রতিনিধি আকাশ কুমারের নামে ৪৭ লাখ ২৫ হাজার ৮২৫ টাকা পরিশোধ করা হয়। একই তারিখে আকাশ কুমার ইস্পাহানি আগ্রাবাদ চট্রগ্রামের নামে ২৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা পরিশোধসহ ধোবাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার হিসেব নম্বরে ২১ লাখ টাকা জমা দেয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে বিনামূল্যে বীজ পেতে কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে নাম দেওয়া হয়েছিল। বরাদ্দের তুলনায় কম দেওয়া হয়েছে। অনেকে বীজ রোপণের পর চারা না গজানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কম দামে নিম্নমানের বীজ কিনে বিতরণ করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নমানের বীজ কিনে সরকারি টাকা আত্মসাতে ঘটনা জানাজানি হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা তুঙ্গে। দুদকের তদন্ত প্রয়োজন।
উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের কাশিনাথপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মোতালেব খবরের কাগজকে বলেন, গত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বিনামূল্যে প্রণোদনার বীজ সহায়তা নিতে কৃষি বিভাগের তালিকায় নাম দিয়েছিলাম। তালিকা অনুযায়ী লাল শাক, বেগুন, শিম, পালংশাক, লাউ, টমেটো ও মিষ্টি কুমড়াসহ ৮ ধরনের ১২ প্যাকেট বীজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পেয়েছি মাত্র ৮ প্যাকেট বীজ। অনেকে পেয়েছেন ৩ প্যাকেট করে। এগুলো রোপণের পর চারা গজায়নি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাদিয়া ফেরদৌসির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বীজ কিনে বিতরণের নামে মোটা অংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কৃষক কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, আমার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রথম তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে আমাকে জানানো হয়েছে, তদন্ত হয়ে গেছে। আমার অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। পরে অভিযোগ তুলে নিয়েছি। আমি কৃষক মানুষ। যার ইচ্ছা অনিয়ম করবে, যার ইচ্ছা করবে না। এতে আমার কি? একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে।
বক্তব্য জানতে চাইলে ধোবাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাদিয়া ফেরদৌসি বলেন, আমার আগে আমার পদে থাকা কর্মকর্তা বিভিন্ন কাগজপত্র প্রস্তুত করেছেন। আমি যোগদানের পর এসবে শুধু স্বাক্ষর করেছি। আমি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করিনি।
বীজ কেনার আগে ইস্পাহানিকে ব্যক্তিগত টাকা অগ্রীম (এডভান্স) দিয়েছিলেন কিনা? দিলে কত টাকা দিয়েছেন? এমন প্রশ্নে নাদিয়া ফেরদৌসি রীতিমতো চুপ হয়ে যান। একপর্যায়ে বলেন, আমি আমার টাকা ওই কোম্পানিকে অগ্রীম দিয়েছি, কিংবা দেইনি। কত টাকা অগ্রীম দিয়েছি সেটা বলব না।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ময়মনসিংহের উপপরিচালক (সাবেক বীজ বিপণন) মুহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে বীজ না থাকায় অন্য কোনো মাধ্যমে থেকে বীজ কিনতে প্রত্যায়নপত্র দিয়েছিলাম। তবে কম টাকায় নিম্নমানের বীজ কেনার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করলে আমার জানার কথা নয়। এটি সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করলে জানা যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ী) ময়মনসিংহের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির প্রধান ড. উম্মে হাবিবা বলেন, তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তবে প্রতিবেদনে কি উল্লেখ করেছি, তা এখনই বলা যাবে না।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন বলেন, এক তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য শেরপুরের আঞ্চলিক কৃষি কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু বলেন, ইস্পাহানী থেকে মোট ৪৭ লাখের অধিক টাকার বীজ কেনা হয়েছে। নাদিয়া ফেরদৌসি আমাকে জানিয়েছে, নিজের ১৪ লাখ টাকা ওই কোম্পানিকে অগ্রীম দিয়েছিল।
তদন্তে এটি প্রমাণ হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নে বলেন, এটি আমার জানা নেই। তবে নাদিয়া ফেরদৌসির কিছু ভুল ত্রুটি রয়েছে। সবমিলিয়ে আবারও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. সালমা লাইজু খবরের কাগজকে বলেন, বীজ দেওয়ার আগে অনেক সময় কোম্পানিকে অগ্রীম টাকা দিতে হয়। সরকারি টাকা না পেলে কৃষকদের সুবিধার্থে কৃষি কর্মকর্তারা বীজ কেনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত টাকা অগ্রীম দিতে পারেন। পরে সেই টাকা কেটেও নিতে পারেন।
তিনি বলেন, ৪৭ লাখ লাখের অধিক টাকার বীজ কেনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ১৪ লাখ টাকা অগ্রীম দেওয়া অস্বাভাবিক। কম টাকায় নিম্নমানের বীজ কিনে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে কিনা, বরাদ্দের বীজগুলো কৃষকদের মাঝে সঠিকভাবে বিতরণ করা হয়েছে কিনা, আসলেই ব্যক্তিগত কোনো টাকা কোম্পানিকে অগ্রীম দেওয়া হয়েছে কিনা, এসব বিষয়গুলো উদঘাটন করতে তদন্ত করা হচ্ছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কামরুজ্জামান মিন্টু/মাহফুজ