
বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর পরিবারের অপেক্ষার অবসান হয়নি, রহস্য এখনো অমীমাংসিত বলে সিলেট জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়। জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেছেন, ‘সিলেট বিএনপি এখনো ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায়। রহস্য এখনো অমীমাংসিত বলে এই মর্মান্তিক বাস্তবতা আমরা কখনো ভুলব না। ইলিয়াসকে ফেরার আশাও ছাড়ব না।’
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে জেলা বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিগত দিনে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আশ্বাস প্রবঞ্চনা ছিল উল্লেখ করে জেলা সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী আরও বলেন, ‘নানা আশ্বাস সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি এখনো জীবিত এবং সংশ্লিষ্ট মহল তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত।”
সিলেটবাসীর হৃদয়ের নেতা ইলিয়াস আলীর খোঁজ না পাওয়া আমাদের জন্য গভীর বেদনা ও ক্ষোভের বিষয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এটি একটি জাতির জন্য চরম লজ্জার। আমরা ন্যায়বিচারের আশায় আজও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত কমিশন গঠনের জোর দাবি জানাই।’
সম্প্রতি ‘আয়নাঘর’ থেকে গুম হওয়া কয়েকজন ব্যক্তি ফিরে আসার প্রসঙ্গ টেনে কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘এই ঘটনাগুলো ইলিয়াস আলী গুমের প্রসঙ্গকে নতুন করে সামনে এনেছে। একইভাবে নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনেদ আহমদের ক্ষেত্রেও তাদের সন্ধান ও মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।’
মানববন্ধনে একাত্ম হয়ে অন্যান্য বক্তারা বলেন, গুমের ঘটনাগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলছে দেশকে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিকমানের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন একান্ত প্রয়োজন। অতীতে যেসব ভুলের কারণে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছিল, বর্তমান সরকার যেন সে ভুলগুলো না করে। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। জনগণ আজ যেসব অপকর্ম দেখে ক্ষুব্ধ, সেগুলো পরিহার করে আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদি, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম, জেলা সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আশিক উদ্দিন আশুক পিপি, সহসভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন।
মানববন্ধনে একাত্ম হন জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজিম উদ্দিন লস্কর, সামিয়া বেগম চৌধুরী, গৌছ আলী, লিলু মিয়া, অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান সুয়েব, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ইশতিয়াক আহমদ সিদ্দিকী, তাজরুল ইসলাম তাজুল, আনোয়ার হোসেন মানিক, কোহিনুর আহমদ, আবুল কাশেম, মাহবুবুল হক চৌধুরী, শাকিল মোর্শেদ, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমদ ও এড. আল আসলাম মুমিন, লোকমান আহমদ, এড. বদরুল ইসলাম চৌধুরী, তাসনিম শারমিন তামান্না, আল মামুন খান, মাহবুব আলমসহ বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা।
মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে ইলিয়াস আলীসহ সকল গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের সন্ধান ও মুক্তির দাবি জানানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে ‘গুম’ হন ইলিয়াস আলী। ছাত্রাবস্থা থেকে সাহসী চরিত্রের ইলিয়াস বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আবাসিক হলের নেতা থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হন। ১৯৮৩ সালে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কাউন্সিলে আন্তর্জাতিকবিষয়ক সচিব নির্বাচিত হন। আশির দশকের মধ্যভাগে রাজধানীতে ছাত্ররাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে ইলিয়াসই প্রথম সেই সময়কার সামরিক শাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এ জন্য ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হন। ১৯৮৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে সাত মাস কারাভোগ করেন। ১৯৯২ সালের ১০ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আবার কারাবন্দি হন। ২৩ মাস কারাভোগের পেছনে ছিল অন্তর্দলীয় ষড়যন্ত্র। তা ভেদ করেন কারামুক্তির মধ্য দিয়ে। তখন বয়সে তরুণ হলেও মূল দলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত ইলিয়াস ভোটের রাজনীতিতে নেমেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন। এরপর ২০০৮ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তার সমর্থকদের অভিযোগ ছিল, ‘ওয়ান-ইলেভেন ষড়যন্ত্রে’ তাকে হারানো হয়। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ তাকে তুলে নেওয়া হয়। সেই থেকে তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি।
ইলিয়াস আলী সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পাশাপাশি সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। তার সাংগঠনিক দায়িত্বে সিলেটে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যে সমাবেশ হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশে পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি উত্থাপন করে ইলিয়াস ভারতের আগ্রাসী তৎপরতার প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানান। এরপর সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে ভারতের টিপাইমুখের বাঁধবিরোধী আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলনে সম্পৃক্তরা বলেছেন, এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় ইলিয়াসও গণমুখী হয়ে উঠেছিলেন। গণমুখী হতেই তিনি ‘গুম’ হন।
শাকিলা ববি/মাহফুজ