নওগাঁয় আলু সংরক্ষণের জন্য সরকারি অর্থায়নে তৈরি করে দেওয়া অহিমায়িত মডেল ঘরগুলো কাজে আসছে না। বেশির ভাগই খালি পড়ে আছে। ঘরে আলু সংরক্ষণ করার পর পচে নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক।
আলুচাষিদের ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে দুই ধাপে জেলার ৩৬ চাষিকে অহিমায়িত মডেল ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বদলগাছী ও মহাদেবপুর উপজেলার ৯ চাষিকে দেওয়া হয় মডেল ঘর।
রড-সিমেন্টের খুঁটির সঙ্গে বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া ও চৌচালা টিনের ছাউনি দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরের ভেতর আলু রাখার জন্য বানানো হয়েছে বাঁশের তাক। প্রতি ঘর তৈরিতে প্রায় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণের এই পদ্ধতি সম্পর্কে উপকারভোগীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ঘর তৈরি থেকে শুরু করে সব কিছুই করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু মডেল ঘরগুলো এখন আর কাজে আসছে না। প্রায় সবগুলোই ফাঁকা পড়ে আছে। চাষিরা বলছেন মডেল ঘরে আলু রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মডেল ঘর পাওয়া একজন জেলার বদলগাছী উপজেলার নাজমুল হোসেন। তিনি জানান, গত মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে আলু উৎপাদন করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় পৌনে ২ লাখ টাকা। ফলন ভালো পেয়েও তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নাজমুল বলেন, ‘ফলন ঘরে তোলার পর হিমাগারে ঠাঁই মিলেনি। ফলে তখনই বাধ্য হয়ে ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে। মডেল ঘরে রেখে ১৫০ মণ আলুতে ভরসা রেখেছিলাম। কিন্তু সংরক্ষণের মাত্র দুই মাসের মাথায় পোকা ধরায় ও পচে যাওয়ায় প্রায় ২০ শতাংশ আলু নষ্ট হয়ে গেছে। আবারও বাধ্য হয়ে ৪৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করে দিয়েছি। লোকসানে পুঁজি হারিয়ে আমি এখন দিশেহারা।’
বদলগাছী উপজেলার বিলাশবাড়ি গ্রামের আলুচাষি আজিজার রহমান জানান, লাভের আশায় আলু উৎপাদন করে চরম বিপাকে পড়েছেন। মৌসুমের শুরুতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্যে হিমাগারে চাষিরা আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাননি। কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও পুঁজিপতিরা মিলে স্টোরেজগুলো বোঝাই করে আলু সংরক্ষণ করেছেন। ফলে অল্প দরে লোকসানে ফলন বেচে দিতে হয়েছে। এ নিয়ে আবাদ ঘরে ওঠার পর থেকেই কৃষকদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। মডেল ঘরও স্বস্তি দিতে পারছে না।
তিনি জানান, স্থানীয় কৃষক সানোয়ার হোসেন সরকারিভাবে তৈরি করে দেওয়া অহিমায়িত মডেল ঘর পেয়ে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে অর্ধেক আলু পচে নষ্ট হয়ে গেছে। লাভের পরিবর্তে লোকসান হয়েছে, প্রণোদনার ঘর কোনো কাজেই আসছে না।
চাষিরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে ঘর তৈরি করায় নিরাপত্তার অভাবে সেগুলোতে আলু সংরক্ষণে আগ্রহ কম। এ ছাড়া নষ্ট হওয়ায় ঘরগুলো আর ব্যবহার হচ্ছে না। ঘর নির্মাণের প্রথম বছর চাষিরা আলু রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পরে মুখ ফিরিয়ে নেন। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বেশির ভাগ ঘর।
নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার বলেন, ‘মডেল ঘরগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে ২ থেকে ৩ মাস আলু সংরক্ষণ করা যায়। আলু সংরক্ষণের পরবর্তী সময়ে চাষিরা সচেতন থাকলে পোকার আক্রমণ এবং পচে নষ্ট হওয়া থেকে ফলন রক্ষা পাবে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে আলু সংরক্ষণের মডেল ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে আগ্রহী চাষিদের মধ্য থেকে উপকারভোগী নির্বাচন করার কাজটি করা হয়েছে। প্রতিটি ঘর তৈরিতে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জেলায় সাতটি হিমাগার রয়েছে। হিমাগারগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু উৎপাদন বেশি হওয়ায় চাষিরা উদ্বৃত্ত ফলন নিয়ে মৌসুমের শুরুতেই কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েন। তাই কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকের বাড়িতে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে মডেল ঘরগুলো তাদের সহায়ক হিসেবে কাজে লাগে এবং সংরক্ষণ খরচ বাঁচে। সনাতন বা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সঠিকভাবে আলু সংরক্ষণ করতে পারলে চাষিরা লাভবান হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।