
পাহাড়, সমুদ্র ও নদীঘেরা চট্টগ্রাম নগরীতে এক সময় বহু খাল ছিল। এই খালগুলো তখন জলপথ হিসেবে ব্যবহার হতো। সময়ের পরিক্রমায় খালগুলো দূষণ, দখলের শিকার হয়েছে। অথচ সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব খাল নগরীর বিকল্প যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব বলে মনে করছেন নগরবাসীসহ বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) বর্ষার আগে কিছু কিছু খাল পরিষ্কার করলেও সেখানে আবারও নগরবাসী পলিথিন, ককশিট আর ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এ কারণে খালগুলো রক্ষা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়নকাজ শেষে যোগাযোগমাধ্যম এবং বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরির জন্য সবগুলো খালে নৌকা ও স্পিডবোট চালুর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম নগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত ৫৭টি খাল। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব খালে পলি জমেছে। পলিথিন, ককশিট আর ময়লা-আবর্জনা ফেলে বছরের পর বছর ধরে খালের ওপর চলছে অত্যাচার। তবে বিশেষজ্ঞ ও নগরবাসী বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের মাধ্যমে যেহেতু ৩৬টি খাল সংস্কার করা হচ্ছে, চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই খাল, মহেশখাল, নালাপাড়া খাল, রাজাখালী খাল, মাঝিরঘাট খাল, হালিশহর খালসহ অন্যান্য খালে নৌকা ও স্পিডবোট চালু করতে পারলে তৈরি হবে ভিন্ন পরিবেশ। খুলবে বিনোদন ও অর্থ উপার্জনের দ্বার।
ইতালি প্রবাসী শেখ নাসির উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইতালির ভেনিস শহরে গাড়ি চালানোর কোনো উপায় নেই। শহরজুড়েই খাল। এসব খালে চলে ওয়াটার ট্যাক্সি। এগুলোই সেখানকার মানুষ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করেন। আবার খালের পাশ দিয়ে হাঁটতে বা ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। আমাদের চট্টগ্রামের খালগুলোকেও যদি ওভাবে পরিকল্পনা করে সাজানো যায়, এটা সবার জন্য ভালো হবে।’
নাসিরাবাদ কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন সম্প্রতি ব্যাংকক ঘুরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংককের খালগুলোতে নৌযান চালানোর কারণে সেগুলো আর বেদখল হচ্ছে না। খালগুলোতে কেউ ময়লা-আবর্জনা না ফেলায় সেগুলো সব সময় পরিষ্কার থাকে। পর্যটকদের আকর্ষণের একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে খালগুলো। কম খরচে যাতায়াতসুবিধা পাওয়ায় সেখানে, তাই সড়কের ওপর চাপ কমেছে।’
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে ৩৬টি খাল পরিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বাকলিয়া এলাকার রাজাখালী-১, রাজাখালী-২ এবং রাজাখালী-৩ এই তিনটি খালে প্রাথমিকভাবে নৌকা ও স্পিডবোট চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু পরে এই উদ্যোগ আর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
চাক্তাই এলাকার বাসিন্দা শফিকুল আলম বলেন, ‘চাক্তাই, রাজাখালী খাল দিয়ে আগে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বেশির ভাগ ব্যবসা হতো। দূর-দুরান্ত থেকে নৌযানে এসে ক্রেতারা পণ্য কিনে নিয়ে যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নৌপথের ব্যবসা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। চাক্তাই-রাজাখালসহ চট্টগ্রামের অন্য খালগুলোতে নৌকা চালু করলে- এটা হবে যুগান্তকারী উদ্যোগ। এতে করে খালগুলো পরিষ্কার ও দখলমুক্ত থাকবে। খালের আশপাশে বসবাসবাসকারী লোকজনও আর ময়লা ফেলবে না। এমনিতেই বিকেলে খালপাড়ে লোকজন হাঁটতে আসে। নৌকা, স্পিডবোট চালু হলে মানুষের আনাগোনা আরও বাড়বে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, ‘একসময় চট্টগ্রাম শহরের প্রায় সব খালে নৌযান চলত। দখল-দূষণের কারণে তা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম শহরের খালগুলোকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চালু করা গেলে শহরের সৌন্দর্য বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি খালগুলো সুরক্ষিত থাকবে। মানুষ কম খরচে যাতায়াত করলে সড়কের ওপর চাপ কমবে। খালগুলো সুরক্ষিত থাকলে আমরা জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকেও মুক্ত হব।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘খালে নৌকা চালাতে হলে আগে সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবব। একটা পরিকল্পনা নিয়ে পুরো চট্টগ্রামকে ঢেলে সাজাব, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা একটি বাসযোগ্য শহর উপহার দিতে পারি।’