
প্লাস্টিক মানুষের জন্য দৈত্য-দানব হয়ে ফিরে আসছে। ধীরে ধীরে এটি মানবজীবনকে গ্রাস করে ফেলছে। মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ জটিল সব রোগ নিয়ে ধরা দিবে আমাদেরই ছুড়ে ফেলা প্লাস্টিক। তাই ছোট থেকে বড় সবাইকে সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে। বিশেষ করে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা এগুলো বর্জন করতে না পারলে সামনে অনিশ্চিত, অনিরাপদ এক ভবিষ্যত উঁকি দিচ্ছে।
সোমবার (২ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা।
‘প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই উদ্ভাবন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শিরোনামে হওয়া ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) নুরুল্লাহ নূরী। তিনি বলেন, তিমি থেকে শুরু করে ছোট ক্ষুদ্রকায় প্রাণী যেটা সেটাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। এমন কোনো বস্তু নেই যেখানে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষের রক্তেও মিশে গেছে। শরীরের কিডনী, হার্ট, মানুষের ব্রেইন সব জায়গায় মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। আমাদের দেহের চর্বির সঙ্গে মিশে আজীবন প্রভাব ফেলবে। এটা নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। ক্যান্সার হচ্ছে। কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছিনা। আমরা ইউক্রেন-রাশিয়া, ভারত-পাকিস্তান নিয়ে যতটা চিন্তিত, ততটা চিন্তিত প্লাস্টিক নিয়ে হচ্ছিনা। হলে এটা মহামারী আকার ধারণ করতো না।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আয়োজিত সেমিনার। ছবি: খবরের কাগজ
তিনি আরও বলেন, আমাদের শহরের প্রাণ হালদা, কর্ণফুলি নদী। সেই নদীকে গিলে খাচ্ছে এই প্লাস্টিক। কর্ণফুলি নদীতে ২২-২৪ ফিট প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। ২-৩ বার খনন কাজ ব্যাহত হয়েছে। এখন এই কারণে পুরোপুরি ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষ করা যায়নি। আমরা যারা পরিবেশে নমুনা সংগ্রহকারী আছি, তারা জানি নদীর পানি কতো দূর্গন্ধ। সেখানে এমন কোনো জিনিস নাই যেটা পাওয়া যাচ্ছেনা। এর কারণ আমরা এগুলো ফেলছি। তাই আসুন সবাই সচেতন হই। প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করি। নিত্য দিনে পলিথিন বর্জন করি। একইসঙ্গে আমরা বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করি। আমরা নিশ্চিয়ই জানি ক্যান্সার হলে কোটি টাকার বেশি খরচ হয় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়। কিন্তু আমাদের পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করলে, প্লাস্টিক বর্জন করলে, বিকল্প ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠলে অতো টাকা খরচ হবেনা।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি এণ্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন। তিনি তার প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন, প্লাস্টিকের ৫ ধরনের সুবিধা ও ৫ ধরনের বিপজ্জনক দিক রয়েছে। ১৯৫০ সালে যেখানে সারাবিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন হতো ২ মিলিয়ন টন। সেখানে ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৪১৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ এই সময়ে ২৩০ গুণ বেড়েছে।
এতে বলা হয়, লাতিন আমেরিকায় ৫ শতাংশ, মিডেল ইস্ট ও আফ্রিকায় ৯%, ইউরোপ ১৪%, নর্থ আমেরিকা ১৭%, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ৫৫% প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে প্যাকেজিং খাতে ৪০%, কনস্ট্রাকশনে ২০%, অটোমোটিভে ৮%, ইলেকট্রনিকসে ৫% প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে। বছরে বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন হয় ৪১৩.৮ মিলিয়ন টন। আর খরচ হয় ৩৬০ মিলিয়ন টন। সেই হিসেবে প্রতিজনে দিনে ০.২ থেকে ০. ৮ কেজি পর্যন্ত খরচ করে থাকে।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট প্লাস্টিকের মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল হয়। আর ১৯ শতাংশ ইনসিনারেট (পুড়িয়ে ফেলা) হয়। আর ৫০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হয়। ২২ শতাংশ মিসম্যানেজড (পরিবেশে মিশে যায়) হয়, যা নানাভাবে পরিবেশ, প্রাণীকূল, মানবজীবনে প্রভাব ফেলে। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ পঁচতে ২০ বৎসর, একটি কাপ ৫০ বৎসর, প্লাস্টিকের স্ট্র ২০০ বছর, বোতল সাড়ে চারশো বছর, ফিশিং লাইন ৫০০ বছর লাগে পঁচতে এবং সৃষ্ট মাইক্রোপ্লাস্টিক আজীবন টিকে থাকে। এগুলো বায়োডাইভারসিটি নষ্ট করে। একইসঙ্গে খাদ্য দূষণ, কেমিক্যাল ছড়ানোসহ নানাভাবে ক্ষতি করে। পৃথিবীর বড় ১ হাজারটি নদী সাগরের ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক জমা হওয়ার জন্য দায়ী। বছরে ১৯-২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ইকোসিস্টেমে মিশে যাচ্ছে।
তিনি তার প্রতিবেদন আরও উপস্থাপন করেন, প্লাস্টিকের দূষণ ট্যুরিজম খাত থেকে শুরু করে মৎস্য, মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট, পরিস্কার খরচ ও স্বাস্থ্য খরচ বাড়াবে।
তিনি জানান, বাংলাদেশে বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলি, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী মারাত্মকভাবে দূষিত। এতে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ নানা দিকে কীভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা তুলে ধরেন।
পরে বিভিন্ন অংশিজনরা প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে এবং বিকল্প ব্যবস্থা সরবরাহে নানা চিন্তা তুলে ধরেন। তারা বলেন, সচেতনতার জন্য আমাদের কন্টেট ক্রিয়েটরকে কাজ লাগাতে হবে। আলেম, ওলামাদের বলতে হবে তারা যেন মসজিদে এসব বিষয়ে বলেন। বাসে, হাসপাতালে, স্কুলে যেন ক্যাম্পেইন করা হয়। সোস্যাল মিডিয়ায় যেন কন্টেট বানিয়ে মানুষকে সচেতন করা হয় কীভাবে প্লাস্টিক ক্ষতি করছে। সেইসঙ্গে কোনটি প্লাস্টিক, কোনটি পঁচনশীল, কোনটি নয় সেটিও জানাতে হবে। আর প্লাস্টিক যারা উৎপাদন করে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে তাদের কারখানা সিলগালাসহ নাগরিক সব সেবা বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের পণ্য বিক্রি করলে ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়তি দিকে হবে। কঠিন শাস্তির মুখে ফেলতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক সোনিয়া সুলতানার সভাপতিত্বে এতে আরও উপস্থিত ছিলেন, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক জমির উদ্দিন। এতে সাংবাদিক, স্বেচ্ছাসেবী, পরিবেশকর্মী ও উদ্যোক্তা, মানবাধিকার কর্মীসহ অনেকে অংশ নেন।
মনির/মাহফুজ