
মঙ্গলবার (৩ জুন) সকাল ৯টা ১০ মিনিট। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের শূন্যরেখা এলাকা। একটি খাটিয়ায় করে ভারতের নদীয়া জেলার এক বৃদ্ধার লাশ নিয়ে আসা হয়। তখন বাংলাদেশ অংশে থাকা দুই নারী কান্না শুরু করেন। খাটিয়ার দিকে এগিয়ে যান। অপলক দৃষ্টিতে লাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাদের আর্তনাদে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে থাকা পুরুষ সদস্যদেরও মুখ মলিন। সেখানে থাকা সশস্ত্র বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যদের সতর্ক অবস্থান দেখা যায়। এভাবে চলল ২০ মিনিট। ৯টা ৩০ মিনিটে আবারও খাটিয়া কাঁধে নিয়ে কয়েকজন মানুষ ভারতের দিকে চলে যান। ওই দুই নারীর কান্না তখনো থামেনি। অপলক দৃষ্টিতে তারা খাটিয়া চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন।
ভারত থেকে আনা খাটিয়ায় ছিল লোজিনা বেগমের লাশ। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি নদিয়া জেলার চাপড়া থানার গোংরা গ্রামে স্বামী-ছেলের সঙ্গে বসবাস করতেন। আর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া যে দুই নারী লাশ দেখে আহাজারি করছিলেন, তারা ছিলেন ওই বৃদ্ধার সন্তান। একজনের নাম বরকতি বেগম (৪৫) অন্যজন কুলসুম বেগম (৪০)। তারা দুজনই বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সীমান্তবর্তী জয়পুর এলাকার বাসিন্দা। বিয়ের পর থেকে তারা সেখানে বসবাস করে আসছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লোজিনা বেগম দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। সোমবার রাতে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে বাংলাদেশে থাকা তার দুই মেয়ে মায়ের লাশ দেখার অনুমতি চেয়ে ৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের জগন্নাথপুর বিওপির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সীমান্তের বিপরীত পাশে থাকা ভারতের ১৬১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের গোংরা ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখতে দুই মেয়ের আকুতির বিষয়টি তাদের কাছে তুলে ধরেন। এতে বিএসএফও সাড়া দেয়। মঙ্গলবার সকালে সীমান্তের শূন্যরেখায় মা হারা সন্তানদের শেষ ইচ্ছে পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। দুই দেশে থাকা বৃদ্ধার স্বজনদের উপস্থিতিতে সীমান্তে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শেষবারের মতো মেয়েরা মাকে বিদায় জানায়।
জানা গেছে, লোজিনা বেগম দীর্ঘবছর ধরে ভারতের নদীয়া জেলায় স্বামী-ছেলেসহ বসবাস করে আসছেন। তবে ঠিক কত বছর আগে তিনি বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছেন এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। তার দুই মেয়ে বরকতি বেগম ও কুলসুম বেগমের বিয়ে খুব ছোট থাকতে হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে খবরের কাগজের পক্ষ থেকে তথ্যগুলো যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে শেষবারের মতো মায়ের মুখ দেখতে পেয়ে দুই মেয়ে বিজিবি ও বিএসএফের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বরকতি বেগম জানিয়েছেন, ‘মাকে স্পর্শ করতে না পারলেও শেষবারের মতো তাকে একবার দেখতে পেয়েছি। তাকে শেষ বিদায় দিতে পেরেছি। এতে মনটা হালকা হয়েছে। বিজিবি ও বিএসএফের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’ একই কথা বলেন লোজিনা বেগমের আরেক মেয়ে কুলসুম বেগম।
চুয়াডাঙ্গা ৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হাসান বলেন, ‘সীমান্তে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখার পাশাপাশি বিজিবি মানবিক দিকেও খেয়াল রাখে। এ বিষয়ে বিজিবি সব সময় আন্তরিক। এ ধরনের ঘটনা পারস্পরিক আস্থা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, শূন্যরেখায় শেষবারের মতো লোজিনা বেগমের বিদায় অনুষ্ঠানে তার বাংলাদেশ অংশে থাকা স্বজন মো. নুরজামান, আবদুস সালাম ও রবিউল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। বিজিবির পক্ষ থেকে জগন্নাথপুর বিওপির কমান্ডার নায়েক সুবেদার আবুল হাসান তার সশস্ত্র দল দিয়ে সেখানে টহলে ছিলেন।