টানা বর্ষণে সাতক্ষীরার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। শহরজুড়ে জল, কোথাও কলাগাছে ভেলা, কোথাও ককশিটে করে শিশুসহ জিনিসপত্র নিয়ে নৌকার মতো ভেসে চলেছেন বিপন্ন মানুষ। রান্না, পানীয় জল ও স্যানিটেশনের ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন হাজার হাজার পরিবার।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিস জানায়, গত দুই দিনে প্রায় ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এতে সাতক্ষীরা পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ডে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কামালনগর, ইটাগাছা, পলাশপোল, মধুমোল্লারডাঙি, মেহেদীবাগ, রসুলপুর, বদ্দিপুর কলোনি, রইচপুর, মধ্য কাটিয়া, রথখোলা, রাজারবাগান, গদাইবিল, মাঠপাড়া, পার-মাছখোলা ও পুরাতন সাতক্ষীরা অঞ্চলে পানি থৈ থৈ করছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ৭ ও ৯নং ওয়ার্ডে।
ইটাগাছা বিলপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হাসান বলেন, 'ঘের মালিকরা বিলে পানি আটকে রেখেছে। বাইপাসের স্লুইস গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি খালে নামছে না। ফলে ঘর-পথ-আঙিনা সব পানিতে তলিয়ে গেছে।'
বদ্দিপুর কলোনির গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, '১০ বছর ধরে প্রতিবছর এমনটা হয়। কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এবার রান্নাঘরেও পানি উঠেছে, হাঁড়ি-পাতিল নষ্ট হয়ে গেছে। পোকামাকড়ের উপদ্রবে ঘুমানোও যাচ্ছে না। সন্তানদের নিয়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে হয়েছে।'
বিল দখলে মাছের ঘের, সংকটে শহর:
কুখরালি এলাকার বাসিন্দা ইকরামুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, 'প্রভাবশালীরা বিলের মুখ বন্ধ করে মাছের ঘের করছে। খালের মুখে নেট-পাটা বসিয়ে দিয়েছেন। ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।'
এইচএসসি পরীক্ষার্থী আফসানা মিমি বলেন, 'পানির কারণে সময়মতো পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে পারছি না। টিউবওয়েল পানিতে ডুবে গেছে। বাধ্য হয়ে পানি কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।'
ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে:
সমাজকর্মী সাজেদুল ইসলাম বলেন, 'নদী ও খাল খননে অনিয়ম হয়েছে। কাগজে-কলমে পাড় উঁচু করে গভীরতা দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পানি বের হওয়ার পথ বন্ধ। ফলে বর্ষার পানি লোকালয়ে ঢুকে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।'
সাতক্ষীরা আদালতের আইনজীবী ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, 'বছরের পর বছর সাতক্ষীরার মানুষ একই দুর্ভোগে পড়ে আছে। পৌর মেয়র ও কাউন্সিলররা শুধু নির্বাচনের সময় এলাকায় দেখা দেন। এখন বলছেন, সরকার পরিবর্তনের পর ঠিকাদার পালিয়ে গেছে তাই কাজ হয়নি। অথচ সমাধান খুব সহজ- নেটপাটা সরানো, স্লুইস গেট সচল রাখা, প্রকৃত গভীরতা অনুযায়ী খাল খনন ও বাঁধ সংস্কার।'
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া:
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমাদ বলেন, '২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ কিমি খাল ও সেচনালা সংস্কার করা হয়েছে। দ্রুত স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হবে। প্রাণসায়ের খালে পানি ফেলার বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আশা করছি, এতে জলাবদ্ধতা কিছুটা কমবে।'
সাতক্ষীরার জনগণ এখন টেকসই ড্রেনেজ পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য অপেক্ষা করছে। বর্ষা আসলেই বিপর্যয় যেন নতুন নয়, এটা রুটিন দুর্যোগে রূপ নিয়েছে।
নাজমুল/মেহেদী/