
চলতি বছর দেশের আট বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদিকে জেলাগুলোর মধ্যে আক্রান্তদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বরগুনায়। বরগুনাকে ইতোমধ্যে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে চিকিৎসক বাড়ানো হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেওয়া হচ্ছে সব ধরনের উদ্যোগ। তবে বরগুনায় আক্রান্ত এত বেশি কেন, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় বরগুনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর বরগুনায় পাঁচজনের মৃত্যু হলো। বরগুনায় গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৭ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫৫২ জন। এই সময়ে বরগুনা ছাড়া বরিশাল বিভাগের অন্য পাঁচ জেলার মধ্যে পটুয়াখালীতে ৯ জন, পিরোজপুরে সাতজন, ঝালকাঠিতে ছয়জন এবং শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩০ জন ভর্তি হয়েছেন। পিরোজপুরে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর এ পর্যন্ত সারা দেশে ৫ হাজার ৪৪১ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৪৮৬ জন। চলতি বছর দেশে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। তাদের সাতজনই বরিশাল বিভাগের।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাসকিয়া সিদ্দিকী বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্য রোগীদের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চিকিৎসা দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। চিকিৎসকসংকট প্রকট। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা অসহায়বোধ করছি।’
বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ জানান, চলতি বছরের মে মাস থেকে বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বরগুনাকে ডেঙ্গুর হটস্পট ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কী কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ এত বেশি তা বলা যাচ্ছে না। হয়তো ডেঙ্গুর জেনেটিক রূপের পরিবর্তন হতে পারে। আবার ডেঙ্গু ভাইরাসের ভ্যারিয়েশন পাল্টে যেতে পারে। এটা গবেষণার বিষয়। আমরা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) বিষয়টি অবহিত করেছি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় জটিল রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ‘আমরা সব ব্যবস্থা নিয়েছি। যেখানে ডাক্তার কিছু কম ছিল সেখানে ডাক্তার দেওয়া হচ্ছে। ছুটির মধ্যেও ডাক্তার মোবিলাইজ করার চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয়ও করছে। রবিবারের মধ্যে আশা করছি, আমরা সব ডাক্তার পেয়ে যাব। বরগুনায় এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এত বেশি কেন, তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
বরিশাল বিভাগের স্বাস্থ্য দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে ওষুধ সরবরাহ ঠিক থাকলেও চিকিৎসকসংকট এবং যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। তারা জানান, ডেঙ্গু রোগীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘প্লাটিলেট সেল সেপারেটর যন্ত্র’ শুধু বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে আছে। জেলা ও উপজেলার অন্য কোনো হাসপাতালে এটি নেই। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে শয্যা এবং কক্ষসংকটের কারণে ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা কোনো ওয়ার্ডে রাখা যাচ্ছে না। তাদের সাধারণ ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ফলে রোগী ও স্বজনদের ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে।
এদিকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে বরগুনায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন স্থানীয়রা। বরগুনার জেলা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পৌরশহরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক স্থানে ময়লা-আবর্জনা আছে। দিনরাত সমানভাবে শহরের সর্বত্র- বাড়িঘরে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য মশার কয়েল, ধূপ জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেওয়ার পরও মশা কমছে না। মশার উপদ্রব কমাতে পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও তারা উদাসীন।’
বরগুনা পৌরসভার সচিব মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শহর পরিচ্ছন্ন নয় এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা সার্বক্ষণিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার অভিযান চালাচ্ছি এবং মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে সে জন্য ওষুধ প্রয়োগ করছি।
খুলনা
খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। চলতি বছর এরই মধ্যে ১৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন দুজন।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩০৮ জন। মারা গেছেন দুজন। চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘গত মাসের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়লেও সেই হার আতঙ্কজনক নয়। কারণ এখন প্রতিদিন দুই-চারজন করে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
রাজশাহী
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে বৃহস্পতিবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত দুই রোগী ভর্তি হয়েছেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে খুবই গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করছি। রোগীর সংখ্যা এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে আরও সহযোগিতা করেছেন আমাদের খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী প্রতিনিধি