নিজেই অন্তত তিনটি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অন্যের হয়ে প্রক্সি দিয়েছেন। বেশিরভাগ সময়ে দক্ষ প্রক্সিপ্রার্থীও খুঁজে দিয়েছেন জয়পুরহাট জেলার কাউসার আলী। গেল ১০ বছর থেকে সরকারি বিভিন্ন গ্রেডের চাকরির পরীক্ষায় প্রক্সিকাণ্ডে জড়িত এই কাউসার। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) প্রক্সিপ্রার্থী খুঁজতে এসে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরা পড়ছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ফলিত পুষ্টি ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী দাবি করা এই অভিযুক্ত। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম তাকে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
জানা যায়, শিক্ষক নিবন্ধন লিখিত পরীক্ষার জন্য জয়পুরহাট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক রেজার জন্য ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থী খুঁজে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন কাউসার। সবই ঠিক ছিল কিন্তু প্রক্সিদাতার সঙ্গে দেনদরবারে না মেলায় তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতে আনা হয় বলে দাবি অভিযুক্ত কাউসার আলীর।
তিনি বলেন, ‘শনিবার এনটিআরটিসির লিখিত পরীক্ষা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এক প্রক্সিপ্রার্থীর খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। সোলায়মান রবিন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাও হয়। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু এখানে আসার পর তারা আগে টাকার দাবি করে। আমি বলেছি পরীক্ষা শেষে টাকা দেব। কিন্তু আগে দেওয়ার জন্য জোর করে। পরে দাবিতে রাজি না হলে, শিক্ষার্থীদের কাছে আমাকে তুলে দিয়ে সটকে পড়ে।’
সাংবাদিক সমিতিতে কাউসারকে আনেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছিলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ও বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের কর্মসংস্থান সম্পাদক পল্লব রানা পারভেজ।
পল্লব বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যায় আমার বন্ধু বিজয় একাত্তর হল ও যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়ার সাকিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে বলে এবং সে বলে সেখানে এক প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যকে ধরা হয়েছে। কয়েকজনকে নিয়ে যেন সেখানে যাই। পরে সেখানে গিয়ে কাউসার নামে ওই লোকের ফোনে ৫০০-এর বেশি চাকরি পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাই। পরে আর বোঝার বাকি নেই সে প্রক্সি বা প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য। পরে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সাংবাদিক সমিতিতে তাকে নিয়ে আসি।’
জড়িত থাকার অভিযোগ ঢাবি-জবিসহ ৯ শিক্ষার্থীর
সাংবাদিকদের সঙ্গে অভিযুক্ত কাউসারের আলাপচারিতায় উঠে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বগুড়ার সরকারি আজিজুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নাম। যারা কি না এই প্রক্সিচক্রে বেশ সক্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী আলী আব্বাস ও ইফরাত হোসাইন, বিজয় একাত্তর হলের সোলাইমান রবিন ও ইকবাল হোসাইন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর রাকিব হাসান।
এ ছাড়া আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের আজিজুল, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের রায়হান, ভুগোল বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শিমুল, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আবুজর গিফারির নামের কথা জানান কাউসার।
প্রাথমিক চুক্তি ২০ হাজার, টিকলে লাখ টাকা
কাউসারের হোয়াটসঅ্যাপে শত শত চাকরির প্রবেশপত্র মিলেছে। কাউসার জানায়, প্রক্সির এই চুক্তিতে প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকার চুক্তি হয়। যেটিকে টিএ/ডিএ বলছেন তিনি। এ সময়ে পরীক্ষার প্রবেশপত্রও জমা রাখা হয়। টিকলে প্রক্সিপ্রার্থী পাবেন এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা।
জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবির কুয়াতপুরের বাসিন্দা কাউসার বলেন, ‘রেলওয়ের পয়েন্টসম্যান, খালাসি ও ময়মনসিংহ পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২-এর মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জার পদে ভিন্ন তিনজনের পরীক্ষায় প্রক্সিপ্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। গত ২৮ জুন রেলওয়ের পয়েন্টসম্যান পদের পরীক্ষায় ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে অংশ নিয়েছিলাম। এ ছাড়া গত ৪ মে অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২-এর মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জার পদের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রিলিমিনারিতে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আমিনুলের মাধ্যমে মুহাম্মদ বুলবুল ইসলাম নামের একজন প্রার্থীর পরীক্ষায় বসিয়েছিলাম। ওই পরীক্ষায় প্রিলিতে পাস হয়েছিল।’
ফোনে প্রশ্ন চেয়ে কাউসারকে একাধিক কল, পুলিশে সোপর্দ
ঢাবি সাংবাদিক সমিতিতে অবস্থানকালে কাউসারের কাছে একাধিক জায়গা থেকে ফোনকল আসে এবং যে কলগুলোতে এনটিআরসিএর বিভিন্ন পরীক্ষার নিয়োগ লিখিত পরীক্ষায় গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়ার কথা বলা হয়। পরে প্রক্টরিয়াল টিমকে পুরো বিষয়টি জানানো হলে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘শুক্রবার রাতেই আমরা অভিযুক্তকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করি। সে এখন পুলিশ হেফাজতে আছে। তার দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তা ছাড়া আটক ওই ব্যক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীর নাম বলেছে, সেসবেরও খোঁজ নিয়ে যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওইসব হলের প্রাধ্যক্ষদের কাছে নাম পাঠানো হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হয় শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাজিরুর রহমানের সঙ্গে। মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ফোনকল ও বার্তা পাঠানো হলে তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
আরিফ জাওয়াদ/সাদিয়া নাহার/অমিয়/