মন ভালো নেই ফুলপরীদের। অনেকদিন হলো গাছে আর ফুল ফুটছে না। ফুল ফুটবেই বা কীভাবে, জীবনই তো টিকছে না। কোনোরকমে বেঁচে আছে ওরা। গন্ধরাজ, কামিনী আর মাধবীলতার গাছগুলোতে কুঁড়ি আসারও লক্ষণ নেই। গোলাপ গাছগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়েছে বেশ আগেই। ফুল না ফুটলে মন ভালো থাকে না ফুলপরীদের। ফুলের গন্ধ নাকে এলেই চনমনে হয়ে ওঠে সবার মন। বাগানে ফুল ফুটলে খুশিতে তাধিন তাধিন নাচে ফুলপরীদের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা। এজন্যই তো ওরা ফুলপরী!
ফুল কেন ফুটছে না? বৃষ্টিরা যে অভিমান করে আছে। প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। খুব কষ্ট হচ্ছে বনের পশুপাখিদের। আকাশে ডানা মেললেই হাঁপিয়ে উঠছে পাখি, শুকিয়ে আসছে গলা। মাঠের সবুজ ঘাস-লতা শুকিয়ে হলুদ হচ্ছে। উড়ছে ধুলো। সবার মতো মন খারাপ করে আছে সব ফুলপরী। সেদিন তো খুব ভোরে গন্ধরাজের কাছে এগিয়ে এল ফুলপরীদের ছোট্টমোট্ট এক মেয়ে। মেয়েটার নাম ফুলন্দী। গন্ধরাজের সবুজ পাতা ছুঁয়ে বলল,
-কবে তোমার ফুল ফুটবে গো দিদা?
-নিজেই বাঁচি না আবার ফুল ফোটাব কোত্থেকে। রুক্ষ মেজাজে বলল গন্ধরাজ।
-কেন গো দিদা?
-এই পুচকে মেয়ে, তুমি কি কিছুই বোঝ না? দেখছ না শুকনো জমিন কেমন করে পানির জন্য হাহাকার করছে। ভেজা জমিন ছাড়া আমরা ভালো থাকি কী করে? কতদিন হলো বৃষ্টি হয় না, দেখেছ?
-ও আচ্ছা, এই কথা? তাহলে আমি আজই মেঘপরীদের বলব বৃষ্টি নামাতে। দেখ বৃষ্টি হবে। ভীষণ বৃষ্টি। টুপটাপ বৃষ্টি, ঝমঝম বৃষ্টি। দেখ, তোমার পাতার গায়ে জমা ধুলো ধুয়ে যাবে। শুকনো মাটি ভিজে যাবে। পাখিদের ডানা ধুয়ে যাবে। কচুর পাতাগুলো দুলে উঠবে। শীতল হয়ে উঠবে বাতাস।
-হা হা হা। দেখা যাক কী হয়। একটু অবজ্ঞার স্বরে বলল গন্ধরাজ।
ফিরে এসে মন খারাপ করে মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল ফুলন্দী। আজ অনেক দূর থেকে কিছু ঝরা সুগন্ধি ফুল এনেছিল মা ফুলপরী। ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে বেশ তরতাজা হয়ে উঠল সে। আকাশের দিকে খানিক তাকিয়ে রইল, কখন মেঘপরীদের দেখা মিলবে।
সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। একখণ্ড হালকা মেঘ উড়ে যাচ্ছিল দূর থেকে। ফুলন্দী চিৎকার দিয়ে এগিয়ে গেল। হাত উঁচিয়ে বলল,
-দাঁ-ড়া-ও গো মেঘপরী খালা। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আমার মনে অনেক ব্যথা জমে আছে।
-কী কথা শুনি? থামল মেঘপরী।
-কতদিন হলো আমাদের এখানে বৃষ্টি ঝরাও না। কী যে কষ্টে আছি। পুকুরে পানি নেই, মাটি বের হয়ে আছে। গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। আর ফুল ফুটছে না। প্রচণ্ড গরমে পশুপাখি হাঁসফাঁস করছে। এতটা পাষাণ কেন তুমি, শুনি?
-এই ফুলপরীদের সোনামেয়ে। এতই যখন তোমার ফুলের দরকার তো উঠে এসো মেঘের ডানায়। তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাই, দেখবে হাজারো ফুল ফুটে আছে ওখানে। যাবে?
-ইশ! আমি কেন অন্যের কাছে যাই! তুমি বরং এখানেই বৃষ্টি ঝরাও। কী সুন্দর আমাদের কামিনী ফুলের ঘ্রাণ! আহ্লাদি কণ্ঠে বলল ফুলপরীদের মেয়ে ফুলন্দী।
-তোমাদের এখানে তো বৃষ্টি নামার কথা নেই গো মিষ্টি মেয়ে। আমরা যাব দূরে, অ-নে-ক দূরে। হিজল, তমাল আর বেগুনি জারুল ফুলের বনে। ঝুমকো জবা, হাসনাহেনা, শিউলি, বেলি আর রজনীগন্ধার গ্রামে। দেখছ না আমরা কেমন ছুটছি।
-আমাদের প্রতি বুঝি তোমাদের অনেক অভিমান? গোমড়া মুখে বলল ফুলন্দী।
-হা হা হা। তোমাদের প্রতি অভিমান করব কেন গো পাগলি মেয়ে। আমাদের যত ক্ষোভ মানুষের ওপর।
-মানুষের ওপর?
-হ্যাঁ গো হ্যাঁ। দেখছ না মানুষ দিন দিন কেমন পাষাণ হয়ে উঠছে। নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলছে। বন উজাড় করছে। নদী-নালা মেরে ফেলছে। আমরা কেন অতটা দয়া দেখাতে যাব?
-তা তো ঠিক বলেছ মেঘপরী খালা, কিন্তু বৃষ্টি না ঝরালে আমরাও যে বিপদে পড়ি।
-এতই যখন প্রয়োজন তখন মানুষের কাছে গিয়ে বল। মানুষ যেভাবে কল-কারখানা, রাস্তাঘাট তৈরি করছে, সেভাবে গাছপালাও লাগাতে হবে। গাছ ছাড়া পৃথিবী ভালো থাকবে?
-তা তো ঠিক, একদম ঠিক কথা। মাথা নাড়ল ফুলন্দী।
-আচ্ছা তুমি যখন এত করে বলছ, কাল তোমাদের এখানে বৃষ্টি ঝরবে। আমি আজই বৃষ্টিরাজকে বলব। খুশি তো? এখন তাহলে যাই, সাগর থেকে পানি আনতে হবে না!
মায়ের কোলে ফিরে এল ফুলন্দী। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সত্যিই কাল বৃষ্টি নামবে! একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে। রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেল ফুলন্দী। টুকটুকে ফুটফুটে এক মানুষের মেয়ে সে। বাবা-মা আদর করে তাকে পরী নামেই ডাকে। দুই কানে ঝুমকো জবা আর খোঁপায় টুকটুকে লাল গোলাপ গুঁজে বাবা তাকে রোজ সাজিয়ে দেয়। ছোট্ট সুন্দর ছায়াঢাকা গ্রাম তার। দুই পাশে বয়ে চালেছে নদী। বাবার খেতের বেগুনডালে টুনটুনি চুইচুই করে ডাকে। বেগুনি রঙের ফুলে বসে প্রজাপতি। ওদের দেখে ছড়া কাটতে থাকে পরী-
প্রজাপতি প্রজাপতি
কোথায় তোমার ঘর,
আমার ভয়ে কাঁপছ তুমি?
অমন থরথর!
আমায় তুমি দাও না ছুঁয়ে
ভাবছ কেন পর।
ঘুম ভেঙেই দেখে সকাল হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মন ভালো হয় ফুলন্দীর। দূর-দূরান্ত থেকে উড়ে আসা মেঘ কালো রঙে ছেয়ে যায়। হঠাৎ উড়ে আসে মেঘরাজ। গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হয়। ঝমঝমিয়ে শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে যায় মাঠ-ঘাট, ফসলের খেত। হাজারো ফুলের গাছ সতেজ হয়। পরীমেয়ে ফুলন্দী ছুঁয়ে দেখে গন্ধরাজের পাতা। এখন অপেক্ষার পালা, আর মাত্র কদিন পরেই ফুটবে নানান রঙের ফুল।
/আবরার জাহিন