বাজেটে বরাদ্দের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধে। প্রতিবছর বাজেটে এই বরাদ্দ বাড়ছেই। ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় এখন বাজেটের সর্বোচ্চ একক খাত। চলতি বছরের বাজেটেও একই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এর মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধেই ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। সুদ পরিশোধের এই ব্যয়ের পরিমাণ প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এই ব্যয়ের বড় অংশই যাবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে।
এই বিপুল বরাদ্দের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ২২ হাজার কোটি টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরে ২০২৪-২৫ সংশোধিত বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যয় বাড়ছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ নিয়েছিল সরকার। চলতি বছর কিছু বৈদেশিক ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় শুধু সুদ নয়, আসল অর্থও পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে চাপ বেড়েছে দ্বিগুণ। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হার বেড়েছে। গত দুই বছরে মুদ্রার অবমূল্যায়নে বৈদেশিক ঋণের বোঝা আরও বড় হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়তে পারে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘ঋণের বোঝা যেভাবে বাড়ছে তার বিপরীতে সুদ পরিশোধে বাজেটের বড় একটি অংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে। এটি সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। সুদ পরিশোধের চাপ কমাতে হলে সরকারকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ তথা রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। তা না হলে সরকার কঠিন চাপের মুখে পড়বে।’
গত কয়েক বছরের সুদ পরিশোধের হিসাবও বড় ঋণ নির্ভরতার আভাস দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ছিল ৭০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। পরবর্তী বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি, ২০২২-২৩ সালে ৯০ হাজার ১৩ কোটি এবং ২০২৩-২৪ সালে ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকায়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর তা বেড়ে ১ লাখ ২২ হাজার কোটিতে পৌঁছাতে চলেছে।
বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্য দুই উৎস থেকে ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ এবং অন্যটি বিদেশি ঋণ। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আবার ব্যাংক ব্যবস্থা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ নেয় সরকার। আর বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থা ও দ্বিপক্ষীয় দেশ থেকে বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে। আর বহুপক্ষীয় সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া হয়। প্রতিবছর বাজেটে এই দুই উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এসব ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে সুদের পেছনে ব্যয় বাড়ছেই।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ঋণ পরিশোধে খরচ হয়েছে ৩২১ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৮ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। গত বছর একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি ডলার (২৮ হাজার ২৮১ কোটি টাকা)। অর্থাৎ পরিশোধের চাপ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।