![যাত্রী ও পথচারীর দুর্ঘটনা বিমা উপেক্ষিত](uploads/2024/03/19/1710838486.bima.jpg)
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ অকালমৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও আংশিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়। এক্ষেত্রে পরিবহন, যাত্রী ও পথচারীর (থার্ড পার্টি) জন্য চিকিৎসা সুবিধা দিতে আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিমা কভারেজ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবটি আমলে নেওয়া হয়নি। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) দেওয়া ওই প্রস্তাবটিতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ থাকলেও, তা সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর সর্বশেষ প্রস্তাবিত সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আইন অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেছেন, অন্যভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকায় বিষয়টি হুবহু প্রস্তাব হিসেবে নেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণ দিতে সরকার ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছে। ওই ট্রাস্ট থেকে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। গত বছর এ ট্রাস্টের কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কিছু ক্ষতিপূরণের চেকও বিতরণ করেছেন।
মো. সাইফুল ইসলাম জানান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-তে সংশোধনীর জন্য গণমতামত নেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। এটি এখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষা রয়েছে।
এদিকে আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী খবরের কাগজকে বলেছেন, দুর্ঘটনায় পরিবহন, যাত্রী ও পথচারীর স্বার্থ সুরক্ষিত করতে প্রতিটি পরিবহন মালিককে বাধ্যতামূলকভাবে বিমা করার প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী মৌখিক অনুমোদন দেন ২০২৩ সালের জাতীয় বিমা দিবসে। এরপর সে প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আমরা পাঠিয়েছি। কিন্তু সেটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হয়নি। প্রস্তাবটিতে সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইনে পরিবহন মালিকরা বিমা করার বাধ্যবাধকতা না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে সুপারিশ করা হয়।
প্রস্তাবটির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে এককালীন ৫ হাজার টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে বিমায় সুরক্ষা দেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হলে যাত্রী ও পথচারীর স্বার্থ সুরক্ষিত হতো এবং একই সঙ্গে বেশি অঙ্কের অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া যেত। এতে একদিকে বিমা কোম্পানির ব্যবসায় প্রসার হতো, বেশি প্রিমিয়াম আয় হতো এবং সরকারের রাজস্ব (ভ্যাট ও ট্যাক্স) আহরণ বাড়ত।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান আরও বলেন, আইনে বিমা বাধ্যতামূলক ও আইন না মানার কারণে শাস্তির ব্যবস্থা করলে পরিবহন খাতে মালিক ও শ্রমিকদের এক ধরনের শৃঙ্খলার আওতায় আনা সম্ভব হতো। এতে সড়কে দুর্ঘটনা হ্রাস ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমত।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসেবে, সড়কে প্রতি বছর সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার মানুষ। শুধু ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৫০০ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে সাত হাজার জন।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, সরকার ২০১৮ সালের আইনে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছে। এ ট্রাস্ট থেকে চার ক্যাটাগরিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবারকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা, পূর্ণ পঙ্গুত্বের ক্ষেত্রে ৪ লাখ, আংশিক পঙ্গুত্ব হলে ৩ লাখ এবং দুর্ঘটনার শিকার যাত্রীর সুস্থ হতে চিকিৎসা সহায়তা দিতে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পক্ষ থেকে আবেদন করার জন্য সারা দেশে বিআরটিএর অফিসে ফরম পাওয়া যায়। ওই ফরম পূরণ করে জমা দেওয়ার পর দুই মাস সময় ধরে তদন্ত হবে এবং এরপর তদন্তের সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের জন্য অর্থ বরাদ্দ ও চেক বিতরণ করা হয়ে থাকে।
এদিকে, আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, দুর্ঘটনা বিমা সারা বিশ্বে একটি জনপ্রিয় বিমা পলিসি। এটি পরিবহন মালিকরা যাত্রী ও পথচারীর জন্য অবশ্য পালনীয় হিসেবে করে থাকে। তিনি বলেন, নতুন আইনে গাড়ির বিমা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান জানান, ২০১৮ সালের মোটরযান আইনে পরিবহন দুর্ঘটনায় যাত্রী ও পথচারীর কোনো বিমা সুরক্ষা নেই। এ বিষয়টি ঐচ্ছিক করে রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ১ মার্চ জাতীয় বিমা দিবসে পরিবহন দুর্ঘটনায় যাত্রী ও পথচারীর বিমা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দেওয়া আইডিআরএর প্রস্তাব ফাইলবন্দি হয়ে আছে সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। মোটরযান আইনে ওই সুপারিশ বিধি আকারে যুক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নেই। আমার মতে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) টিপিএর ভূমিকা পালন করতে পারে।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, ১৯৮৪ সালের সড়ক পরিবহন আইনে গাড়ি বিমা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু বিমা কোম্পানিগুলো ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করত বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত বা তার পরিবার ক্ষতিপূরণের অর্থ পেত না। এমন অভিযোগ থেকে ২০১৮ সালে গাড়ি বিমার বাধ্যবাধকতা থেকে সরে আসে সরকার। গঠন করা হয় ট্রাস্ট। ওই ট্রাস্ট এককালীন চাঁদার বিনিময়ে পরিবহন খাতকে বাধ্যতামূলক বিমা থেকে অব্যাহতি দেয়। কিন্তু উন্নত দেশে বিমা কোম্পানির মাধ্যমেই এ দায় বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, উন্নত দেশে থার্ড পার্টি অথরিটি (টিপিএ) আছে। ওই অথরিটি পথচারীর জন্য ক্ষতির ধরন নির্ণয় করে ক্ষতিপূরণ দিতে সুপারিশ করে থাকেন। আমাদের দেশে এ ধরনের ব্যবস্থায় আসতে হবে।