
ঈদকে সামনে রেখে চাহিদা বাড়ে দেশীয় ছাপা কাপড়ের। তাই জমজমাট দেশের সবচেয়ে বড় দেশীয় কাপড়ের পাইকারি বাজার নরসিংদীর শেখেরচর বাবুরহাট। গত বছরের চেয়ে কাপড়ের দাম বেশি হলেও চাহিদামতো কাপড় কিনতে দেখা গেছে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ক্রেতাদের। তবে গতবারের চেয়ে কাপড়ের জোগান কম বলে জানান বিক্রেতারা।
স্থানীয় কাপড় উৎপাদন করা পাওয়ারলুম মালিকরা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার সুতার দাম প্রতি পাউন্টে ২০ টাকা বেশি, তাই কাপড়ের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া কাপড় তৈরির কাঁচামাল সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত বাবুরহাটে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ দোকান রয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার এ তিন দিন কাপড়ের হাট বসে। তবে ঈদ মৌসুমে রবিবার ও সোমবার কাপড় কেনাবেচা হয়ে থাকে।
সম্প্রতি সরেজমিনে বাবুরহাট ঘুরে দেখা গেছে, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও কাপড়ের ভিন্ন জাতের রং ও ডিজাইনের শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস, থান কাপড়, বিছানার চাদর, শার্টের কাপড়, প্যান্টের কাপড়, পাঞ্জাবির কাপড় ও গামছাসহ দেশীয় প্রায় সব ধরনের কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া হাটে পাওয়া যাচ্ছে আমদানি করা শাটিন কাপড়, বোরকাসহ নানা জাতের কাপড়।
হাটে কাপড় কিনতে আসা স্বর্ণা রাণী শাহ জানান, প্রথমবারের মতো তিনি ঢাকার মালিবাগ থেকে বাবুরহাটে কাপড় কিনতে এসেছেন। ওড়না, ব্লাউজ, সালোয়ারের জন্য এক রঙের কাপড় ও গোল জামা, ম্যাক্সির জন্য প্রিন্টের গজ কাপড় কিনেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এগুলো তিনি অনলাইনে বিক্রি করবেন। রোজায় ছাপা ও গজ কাপড় চাহিদা বেশি থাকে বলে জানান তিনি।
ঝালকাঠি থেকে লুঙ্গি-গামছা নিয়ে হাটে এসেছেন তায়েব আলী মুন্সি। তিনি জানান, তাদের বাড়িতে ৮টি হস্তচালিত তাঁতকল আছে। তাদের তাঁতকলে ছোটদের লুঙ্গিসহ প্রায় ছয় রকমের গামছা তৈরি করেন। একটা সময় ৫ টাকা দামের গামছা বিক্রি করেছেন। এখন ৩০০ টাকার গামছাও রয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবারে হাটে আসেন এবং শুক্রবার চলে যান।
সিলেট থেকে আলাউদ্দিন শেখ ও তার বন্ধু রফিক মিয়া কাপড় কিনতে বাবুরহাটে এসেছেন। তারা জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে তারা কাপড়ের ব্যবসা করছেন। দুজনেই এই হাট থেকে পাইকারি দরে কাপড় কিনে সিলেটের জিন্দাবাজার, জাফলং শাহপরানসহ গ্রামের বাজারগুলোর দোকানে বিক্রি করেন। তারা আনুমানিক ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার লুঙ্গি, গামছা, তাঁতের শাড়ি ও বিছানার চাদর কিনেছেন। এবার কাপড়ের দাম কিছুটা বেশি।
পছন্দ অনুযায়ী নতুন নতুন ডিজাইনের কাপড় কিনতে দোকানে দোকানে ভিড় করছেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। বাজারের প্রতিটি গলিতে কাপড় আনা নেওয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। সবাই যে শুধু ঈদের জন্য জামা কাপড় কিনতে এসেছেন তা নয়। অনেকেই এসেছেন পাইকারি দারে জাকাতের কাপড় কিনতে।
অন্য জেলার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভিড় করছেন স্থানীয় খুচরা ক্রেতারাও। নরসিংদী পৌর শহরের বাসিন্দা রবিন সরকার জানান, দুটা লুঙ্গি ও একটি বোরকা কিনেছেন। শহরের খুচরা দোকান থেকে ২০০ টাকা কমে পেয়েছেন কাপড়গুলো।
বাবুরহাটের বাসিন্দা কাপড় ব্যবসায়ী একে ফজলুল হক বলেন, ‘এখন ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে হাট জমজমাট হয়ে উঠেছে। ১৯৩৭ সালে কালু বাবু নামে এক জমিদার কাপড়ের বাজারের জন্য এক একর জমি দান করেন। বর্তমানে ১৫ একর জমিজুড়ে এই হাট বসে। পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে বাজারটি পরিচালিত হয়।’
শেখেরচর বাবুরহাট বণিক সমিতির সভাপতি ও শিলমান্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গেয়াস উদ্দিন মাস্টার বলেন, ‘হাটের দোকানগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঈদকে ঘিরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার কেনাবেচার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি ক্রেতারা আসতে শুরু করায় রোজার এক সপ্তাহ আগে থেকেই পুরোদমে কেনাবেচা শুরু হয়েছে। বাবুরহাটে দেশের কাপড় উৎপাদনকারী প্রায় সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব একাধিক শোরুম রয়েছে। এসব বস্ত্র কোম্পানির বেশির ভাগ কারখানাও নরসিংদী জেলাকেন্দ্রিক। ফলে এখানকার উৎপাদিত কাপড়ের গুণগত মান ভালো হওয়ার পাশাপাশি দামেও সাশ্রয়ী। দেশের ৭০ ভাগ কাপড়ের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।’
এদিকে চার মাসের ব্যবধানে ফের শনিবার (২৩ মার্চ) রাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩২টি দোকান পুড়ে গেছে। এ ঘটনার পর থেকে বাজারে অন্য ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন দোকান মালিককে খোলা আকাশের নিচে কাপড় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, হাটে অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও বাবুরহাটের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হাটকে আধুনিকায়ন করতে হবে।
হাটে আগুন লাগার কারণ খুঁজতে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করেছে নরসিংদী জেলা প্রশাসক। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।