হাঙ্গেরি তাদের দেশে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। চীনা প্রযুক্তির জন্য নিজেদের মনখোলা হওয়ার বিষয়ে খোদ দেশের ভেতরে প্রতিবাদ থাকলেও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছে দেশটির সরকার। খবর বিবিসির।
বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যাটারি তৈরির জন্য তার দেশের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা সম্পর্কে গত বছরের অক্টোবর মাসে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বনেতা হতে চাই না, কারণ বিশ্বনেতা চীন।’
বিবিসির খবরে বলা হয়, লিথিয়াম-আয়ন গ্লোবাল ব্যাটারি উৎপাদনে চীনের অবদান ৭৯ শতাংশ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ৬ শতাংশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। হাঙ্গেরি বর্তমানে ৪ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এবং শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করার লক্ষ্য রয়েছে দেশটির। বড় ধরনের কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে নির্মিত, নির্মাণাধীন রয়েছে অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে- এমন কারখানার সংখ্যা ৩৬টি। সে কারণে হাঙ্গেরির পরিকল্পনা বা কথাগুলো অহেতুক গর্বের কোনো বিষয় ছিল না।
ভিক্টর অরবানের ফিডেজ (হাঙ্গেরিয়ান নাগরিক জোট) সরকার তাদের ‘প্রাচ্যের জন্য উন্মুক্ত’ নীতির কারণে প্রশংসা কুড়িয়েছে। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বুদাপেস্ট ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দেশটির ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক। বৈদ্যুতিক গাড়ি এই উদ্যোগের ভিত্তি এবং এ ক্ষেত্রে হাঙ্গেরি অন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যদের অনুমোদনের পরিবর্তে তাদের ঈর্ষা লাভ করছে।
এই গ্রীষ্মের মধ্যে বুদাপেস্ট ও চীনা শহরগুলোর মধ্যে সপ্তাহে ১৭টি ফ্লাইট চলবে। ২০২৩ সালে ১ হাজার ৭০ কোটি (১০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ইউরো বিনিয়োগের মাধ্যমে হাঙ্গেরিতে একক বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেছে চীন।
হাঙ্গেরিতে চীনা বিনিয়োগের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বিবিসি বলছে, ডেব্রেসেনের রিফর্মড গ্রেট চার্চের টাওয়ার থেকে দক্ষিণে তাকালে দেখা যায়, চীনের সিএটিএল (কনটেম্পোরারি অ্যামপেরেক্স টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড) কারখানার ধূসর বিল্ডিং ব্লকগুলো দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব হাঙ্গেরিতে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।
গত বছর পর্যন্ত সূর্যমুখী ও পাকা তৈলবীজ, খেতগুলোকে সবুজ ও হলুদ রঙে রাঙিয়ে দিত। বর্তমানে সেখানে চীনের সেমকর্পের সেপারেটর ফয়েল কারখানা এবং চীনা ইকোপ্রো ক্যাথোড প্ল্যান্টও গড়ে উঠেছে।
ডেব্রেসেনের নতুন অল ইলেকট্রিক বিএমডব্লিউ কারখানার নির্মাণ সাইটে গেলে দেখা যাবে, আরেকটি চায়নিজ ব্যাটারি নির্মাতা ইভ এনার্জির কারখানা। ইতোমধ্যে দক্ষিণ হাঙ্গেরিতে বুলডোজার দিয়ে ৩০০ হেক্টর এলাকার মাটি তুলে ফেলা হয়েছে, যাতে করে অঞ্চলটিতে বিওয়াইডির বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য একটি চীনা ‘গিগাফ্যাক্টরি’ তৈরি করা যায়।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের কারখানাগুলো ইতোমধ্যেই এখানে গাড়ির ব্যাটারি বা ব্যাটারির যন্ত্রাংশ তৈরি করা শুরু করেছে।
সিএটিএলের হাঙ্গেরিয়ান বিভাগের নয়েমি সিডলো বলেছেন, ইউরোপের কেন্দ্র এবং স্বয়ংচালিত শিল্পের বৃহত্তম শিল্প কোম্পানিগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে হাঙ্গেরি। তিনি আরও বলেন, হাঙ্গেরির একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল এবং স্থানীয় ও আশপাশের জাতীয় সরকারগুলোও তাকে সাহায্য করতে আগ্রহী ছিল। যে কারণে সেখানে বিশাল বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে।
খবরে বলা হয়, অরবানের ফিডেজ সরকার চীনা বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে। চুক্তিটি সম্পন্ন করার জন্য সিএটিএল ৮০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ইউরো কর প্রণোদনা এবং পরিকাঠামোগত সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা মোট ৭৩০ কোটি (৭ দশমিক ৩০ বিলিয়ন) ইউরোর বিনিয়োগের ১০ শতাংশেরও বেশি।
অন্যদিকে মধ্য ইউরোপকে থেসালোনিকি ও পাইরাস বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে একটি দ্রুতগতির রেলপথে চীনা বিনিয়োগ যোগ করা এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য বুদাপেস্টের উৎসাহ আরও স্পষ্ট।
এই সম্পর্কে দেশগুলোর পারস্পরিক অনুভূতি প্রায় একই বলে মনে হচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মে মাসে যখন ইউরোপে আসবেন, তখন তিনি ফ্রান্স, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি- মাত্র এই তিন দেশ সফর করবেন।
ভিক্টর অরবানের পরিকল্পনা কি ভুল?
এই কারখানা স্থাপন নিয়ে অনেকে ভিক্টর অরবানের সমালোচনাও করেছেন। সম্ভাব্য সমস্যা সম্পর্কে ফিডেজ নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো প্রায় নীরব হলেও কারখানাগুলোর স্বচ্ছতার বিরুদ্ধে পরিবেশগত প্রতিবাদ বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডেব্রেসেনের মেয়র লাসজলো পাপ বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাঙ্গেরিয়ান ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সির কাছে বারবার ই-মেইল করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিরোধীদের অভিযোগ যে, প্রকল্পগুলোকে ‘বর্ধিত জাতীয় স্বার্থ’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো উপায় নেই।
খবরে বলা হয়, ডেব্রেসেনের দক্ষিণে রয়েছে মাইকপারক্সের সুন্দর গ্রাম, যা নির্মাণের স্থানগুলোর দ্বারা ক্রমেই ছোট হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় ক্যাম্পেইনার ইভা কোজমা বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে কেউই সবুজ (পরিবেশবান্ধব) গাড়ির বিরুদ্ধে নই, কিন্তু এটা অবিশ্বাস্যভাবে অন্যায় যে, তারা স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা না করেই এখানে এত বড় কারখানা তৈরি করেছে।’
হাঙ্গেরির অন্যান্য স্থানে ব্যাটারি কারখানার কারণে পরিবেশগত সমস্যাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে কোজমা বলেন, ‘এখানে প্রত্যেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হলে এটিকে আমরা একটি সবুজ ভবিষ্যৎ বলতে পারি না, কারণ অন্যান্য শহরে যারা আমাদের চেয়ে ভাগ্যবান তারা তাদের সুন্দর সবুজ গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে পারে।’
তবে সিএটিএলের নয়েমি সিডলো জোর দিয়ে বলেছেন যে, তার (ইভা কোজমা) ভয় ভিত্তিহীন।
এদিকে পানি সরবরাহও ডেব্রেসেনে একটি প্রধান সমস্যা। খবরে বলা হয়, গ্রেট হাঙ্গেরিয়ান সমভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় ডেব্রেসেনে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জলের সরবরাহ কমে গেছে এবং দানিয়ুব ও টিসজা নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আরও বেশি পানি ধরে রাখার জন্য সরকারি পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত যৎসামান্যই রয়ে গেছে।
ইলেক্ট্রোমোবিলিটি পরাশক্তি হয়ে ওঠার জন্য হাঙ্গেরি জলের পরাশক্তি হিসেবে তার মর্যাদা বিক্রি করে দেওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে। এর আগে ১৯ শতকের মানচিত্রগুলোতে দেখা যায়, দেশের বেশির ভাগ অংশ পানিতে আচ্ছাদিত ছিল।
হাঙ্গেরির আরেকটি সমস্যা হলো শ্রম, যেখানে দেশটির বেকারত্ব হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে।
সিএটিএলের একাই ৯ হাজার কর্মী প্রয়োজন, কিন্তু হাঙ্গেরির সরকার ‘অভিবাসীদের দূরে রাখুন’ স্লোগানে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে।
ডানপন্থি আওয়ার হোমল্যান্ড মুভমেন্ট সম্প্রতি ডেব্রেসেনে বিএমডব্লিউ কারখানা নির্মাণে নিযুক্ত তুর্কি শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে সমালোচকরা আরও একটি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা হলো সস্তা শ্রমিক, সস্তা জমি এবং সরকারের উদার প্রণোদনার কারণে হাঙ্গেরি চীনা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় কোম্পানিগুলোর ‘দাস রাষ্ট্রে’ (সার্ভেন্ট স্টেট) পরিণত হবে।
এদিকে হাঙ্গেরির সরকারও স্বীকার করে, একটি ঝুঁকি রয়েছে যে মজুরি কম পাওয়া যাবে এবং দেশীয় গবেষণা ও উন্নয়ন প্রভাবিত হবে।
তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের রাজনৈতিক পরিচালক বালাজ অরবান বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের বিনিয়োগকারীদের বোঝাতে হবে, এখানে শুধু উৎপাদন করলে হবে না, গবেষণাও করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কীভাবে হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাদের গবেষণা একত্র করব, আগামী ১০ বছরের জন্য এটি আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’