চলতি অর্থবছর শেষ হতে বাকি আছে আর ১৭ দিন। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, বছরের শেষে এবারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঘাটতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, এখন পর্যন্ত যে হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে তাতে চলতি অর্থবছর শেষে ৩ লাখ ৮০ থেকে ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। এবার এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
তবে এনবিআরসংশ্লিষ্টরা ভিন্ন মত জানিয়েছেন। তারা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, এবারে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও ঘাটতির পরিমাণ কম থাকবে। অর্থবছরের শেষ সময়ে এনবিআর কর্মকর্তারা বকেয়া আদায়ে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও তারা জানান।
এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) মো. মাসুদ সাদিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘শেষ সময়ে অনেক খাতে রাজস্ব আদায় বাড়বে। চলতি অর্থবছরে ঘাটতি হবে না বলেই মনে করছি।
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে এনবিআরের সব কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিয়মিত ও বকেয়া আদায়ে জোর চেষ্টা করছেন। মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কতটা আদায় করছেন, কি কৌশলে কাজ করছেন সব নজরদারি করা হচ্ছে। তবে আদায় বাড়াতে গিয়ে সাধারণ করদাতাদের যেন হয়রানি না করা হয় সেদিকে সতর্ক রয়েছেন।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প খাত ভালো নেই। তাই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি আছে। এবারে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হতে পারে।
সূত্র জানায়, বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও এতদিন যারা দিচ্ছি-দেবোতেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এনবিআর। বিশেষভাবে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বকেয়া রাজস্ব আদায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ বড় অঙ্কের বকেয়া আদায় হয়েছে।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় করতে না পারায় এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ের যে সংশোধিত লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে ২৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা কম আদায় করতে পেরেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে চলতি অর্থবছর এনবিআরকে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
চলতি মাসেই আইএমএফ থেকে ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড় করার কথা আছে। আইএমএফ থেকে শর্ত দেওয়া আছে, এনবিআর রাজস্ব আদায়ে সফলতা দেখাতে পারলে ঋণের কিস্তি ছাড় করা হবে। গতকালও আইএমএফ প্রতিনিধিদের একটি দল এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে আইএমএফ এনবিআরের আদায় পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চেয়েছে। এ সময়ে এনবিআর কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায়ের নানা কৌশল আইএমএফের কাছে তুলে ধরেন।
তারা জানান, পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের ৩০ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে বকেয়া ৮ হাজার ৮০২ কোটি টাকা পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে সংস্থাটির। ভূমি রেজিস্ট্রেশন, ভ্রমণ কর, টোব্যকো কর, পরিবেশ সারচার্জ, করের পরিধি বৃদ্ধি, কার্বোনেটেড বেভারেজ ও বকেয়া কর আদায়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় হচ্ছে। ভ্যাট বিভাগ সিগারেটের করহার বৃদ্ধি, মোবাইল ফোন, পলিপ্রপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, বল পয়েন্ট কলম, সফটওয়্যার, এলপিজির অব্যাহতি উঠিয়ে ও ইএফডি মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে আদায় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।
রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এমন সব প্রতিষ্ঠানে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং শুল্ক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। আর এতেও বড় অঙ্কের অর্থ আদায় হচ্ছে বলেও এনবিআর কর্মকর্তারা জানান। সব কিছু মিলিয়ে অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি কমবে বলে তারা আশা করেন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে দেশে রাজস্ব আদায়ে কিছুটা নেতিবাচক ধারা রয়েছে। তবে এনবিআর হতাশ না। যেকোনো পরিস্থিতির মধ্যেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। আশাকরি ভালো ফল আসবে।