সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সারা বছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এ অঞ্চলে আসেন। সাপ্তাহিক সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে দুটি ঈদে সিলেটে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। আর তাদের বরণে নানা প্রস্তুতি নেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। কেউ হোটেল বুকিংয়ে ছাড় দেন, কেউ স্বল্পমূল্যে খাবারের প্যাকেজের অফার দেন, কেউবা আবার পণ্য কেনায় ছাড় দেন।
কিন্তু এবার ঈদুল আজহার সময় সিলেটে বন্যায় সব হিসাবনিকাশ পাল্টে গেছে। কারণ ঈদুল আজহার একদিন আগ থেকে বজ্রসহ বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত চলমান থাকার কারণে সিলেটের নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে।
ফলে ঈদের দিন থেকে বন্যায় প্লাবিত হতে থাকে সিলেট নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলা। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ এলাকার মানুষজন খুব তাড়াতাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়েন। নিরাপত্তার স্বার্থে এই দুই উপজেলার সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তাই এই ভরা মৌসুমে সিলেটের পর্যটননির্ভর ব্যবসায় ধস নেমেছে।
সিলেটে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলমান এই বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেটে এবার ঈদে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।
বন্যার কারণে সিলেটের সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় অন্য ব্যবসায়ীদের মতো ক্ষতির শিকার হয়েছেন জাফলং জিরো পয়েন্টের কাপড় ব্যবসায়ী নূর নবী। তিনি বলেন, ‘এখন জাফলং জিরো পয়েন্টে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকার কথা। কিন্তু বন্যা সব শেষ করে দিয়েছে। আমাদের পরিবার এই ব্যবসার টাকা দিয়ে চলে। কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় আমরা কোনো ব্যবসা করতে পারিনি। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
জাফলং জিরো পয়েন্টের কসমেটিকস ব্যবসায়ী আব্দুল কাদির বলেন, ‘আগে ঈদের দিনেও আমাদের দোকান খুলতে হতো। কারণ ঈদের দিন থেকে পর্যটক আসা শুরু হয়। কিন্তু এবার কিছুই হয়নি। বন্যায় ঘরবাড়ির সঙ্গে আমাদের ব্যবসাও ডুবে গেছে। খুব সংকটে আছি।’
সাদাপাথর পর্যটন স্পটের কসমেটিকস ব্যবসায়ী আলিম উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ ঢলের পানি এসে অর্ধেকেরও বেশি মালামাল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ব্যবসা করার মতো পুঁজি নেই। তার ওপর বন্যার জন্য স্পটও বন্ধ। তাই সব ছেড়ে বাড়ি চলে আসছি। এখন পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করছি। কীভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াব বুঝতে পারছি না।’
জাফলং পর্যটনকেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. হোসেন মিয়া বলেন, ‘পর্যটকদের ওপর আমাদের ব্যবসা নির্ভর করে। জাফলংয়ে প্রায় ৬০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। এই ৬০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ঢলের পানিতে অনেকের দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। অনেকের মালামাল ভেসে গেছে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী লোন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এই ভরা মৌসুমে ব্যবসা করতে না পারায় এই লোনের কিস্তি দিতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।’
সিলেট নগরীর পানসী রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত মাসে একবার বন্যা হলো। এই মাসে আবারও বন্যা। এর প্রভাব আমাদের ব্যবসার ওপরও পড়েছে। কারণ আমাদের ব্যবসা পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। ঈদের ছুটির এই সময় আমাদের রেস্টুরেন্টে উপচে পড়া ভিড় থাকে। কিন্তু পর্যটন স্পট বন্ধ থাকার কারণে এবার ভিড় নেই।’
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবসৃষ্ট?
ঈদের সময় বন্যায় সিলেট প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘বন্যার কারণে সিলেটে কোনো ঈদের আমেজ নেই। সিলেট মূলত কৃষি, মৎস্য, পর্যটন এবং বিদেশি রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। বন্যার আগ্রাসনে আমাদের এসব অর্থনৈতিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। এতে সিলেটের অর্থনীতির মারাত্মক হচ্ছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলব এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবসৃষ্ট। এসবের জন্য দায়ী আমাদের সমাজের রাঘব বোয়ালরা। সিলেটে সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে ভারত থেকে সিলেট এলাকার নদীগুলোয় বিপুল পরিমাণ পাথর এসে জমা হয়েছে। পাথর জমা হওয়ার কারণে নদীর নাব্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি গতিপথও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, নদী ভরাট হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন পুনরায় চালু করা হলে নদীর নাব্য বৃদ্ধি ও গতিপথ স্বাভাবিক হবে। কিন্তু সেটা করা হবে না, কারণ পাথর উত্তোলন চালু হলে অনেকের ক্ষতি হয়ে যাবে।’
বছরের পর বছর ধরে সিলেটের নদ-নদীগুলো খনন হচ্ছে না জানিয়ে এই চেম্বার নেতা বলেন, ‘পলিমাটি জমতে জমতে এখন আমাদের নদীগুলোর আর পানি ধারণের ক্ষমতা নেই। আমার ৫৫ বছরে আমি কোনো দিন শুনিনি সিলেটের কোনো নদী খনন হতে। কিন্তু বন্যা হলেই এমপি-মন্ত্রীরা এসে বলে যান এত এত কিলোমিটার নদী খনন হচ্ছে। পলিথিনের কারণে নদী খনন করা যাচ্ছে না। এসব তাদের মিথ্যা আশার বাণী। দেশে এত প্রযুক্তি, এত উন্নত মেশিনারি থাকার পরও পলিথিনের কারণে নদী খনন করতে পারেন না তারা। এ ধরনের হাস্যকর অযৌক্তিক কথাও শুনতে হয় নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে। সিলেটর এই পরিস্থিতি দ্রুত সমাধানে সরকার যদি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে, তাহলে সিলেটের অর্থনীতি দিন দিন তলানির দিকে যাবে এবং এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়বে।’