দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকার একাধিক ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবগুলো থেকে ব্যবসায়িক লেনদেন, আমদানি ঋণপত্র খোলা, কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির মতো জরুরি পরিষেবা বিল ও গ্রুপের কাছে সরকারের প্রাপ্য কর, ভ্যাট ও কাস্টমস শুল্ক পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে সহযোগিতা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) গ্রুপটির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা শিখা খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বিষয়টি আগেই স্পষ্ট করেছেন যে, কোনো যৌথ মালিকানার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়নি। আজ এস আলম গ্রুপের আবেদন পাওয়ার পর আমি নিজে বিএফআইইউ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছি। সেখান থেকে জানানো হয়, ইতোমধ্যে যাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে তার সবই ব্যক্তির এবং একক ব্যক্তির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোনো যৌথ মূলধনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে মুখপাত্র আরও বলেন, ‘আজই আমরা এস আলম গ্রুপের আবেদন পেলাম এবং জানতে পারলাম যে তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন বিঘ্নিত হচ্ছে বিধায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউয়ের সহযোগিতা চেয়েছে। এখন খোঁজখবর নেওয়া ও অভিযোগের সত্যতা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে সে সিদ্ধান্ত সময়মতো সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হবে।’
এর আগে বিএফআইইউয়ের উপপ্রধান মো. রফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কোনো ব্যাংক যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে থাকে তাহলে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের জানাতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আমরা শুধু ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছি। এর বাইরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রতিটি ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া ছাড়াও আমরা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছি।’
গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রথম ঘোষণা দেন যে, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে না। তিনি বলেছিলেন, এর উদ্দেশ্য দুটি। এক. বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যালু নষ্ট করতে চায় না। দুই. ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত কর্মসংস্থান, বেতন-ভাতা তথা জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো ক্ষতি বাংলাদেশ ব্যাংক করবে না।
গভর্নর বলেন, ‘গণমাধ্যমে এসব নিয়ে অপপ্রচার বা অভিসন্ধিমূলক সংবাদ প্রচার হচ্ছে, যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।’
এদিকে এস আলম গ্রুপ লেনদেন করতে না পারায় ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে চিঠি দিয়েছে তারা।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির যেসব হিসাব ছিল, সেগুলো স্থগিত করা হয়েছে এবং এ জন্য কর্মীদের সময়মতো বেতন-ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। তাতে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এস আলম গ্রুপ তার ব্যাংক হিসাব থেকে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ করতে পারছে না। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা বিভাগের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির মতো পরিষেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের পক্ষে সরকারকে কর, ভ্যাট ও কাস্টমস শুল্কও পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, গ্রুপটির খাদ্য ও সহায়ক অন্যান্য পণ্যের এলসি বা আমদানি ঋণপত্র জোরপূর্বক বাতিল করা হচ্ছে। এস আলম গ্রুপ মনে করছে, এর ফলে দেশে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের সংকট হতে পারে। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির বেচাবিক্রি কমে যাচ্ছে। ক্রেতা ও সরবরাহকারীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও হচ্ছে।
এদিকে এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে খবরের কাগজকে জানানো হয়েছে যে, বর্তমানে দেশে ভোগ্যপণ্যের (সয়াবিন, পামওয়েল, ডাল, ছোলা ও চিনি) চাহিদা পূরণে এস আলম গ্রুপ নিয়মিত এককভাবে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে। দেশে রমজান মাসসহ বিভিন্ন সময়ে সরবরাহজনিত সংকটে এস আলম গ্রুপ জরুরিভিত্তিতে এসব ভোগ্যপণ্য আমদানির উদ্যোগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
একটি খতিয়ান থেকে তা স্পষ্ট হতে পারে। কোম্পানিটি গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন চিনি আমদানি করে, যার মূল্য ৪৯ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার। গত তিন বছরে (২০২৩, ২০২২, ২০২১) চিনি আমদানির সম্মিলিত পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন, যার মূল্য দাঁড়ায় ৮২ কোটি ৬১ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ ডলার। এ ছাড়া গত বছর (২০২৩ সালে) ৫ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানির বিপরীতে ব্যয় হয় ১৫ কোটি ডলার। গত তিন বছরে (২০২৩, ২০২২, ২০২১) গমের আমদানির সম্মিলিত পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১০ হাজার টন যার মূল্য ৫০ কোটি ডলার। গত বছর পাম ও সয়াবিন তেলের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পাম তেল ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন এবং সয়াবিন তেল ছিল ৩৬ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। আর্থিক হিসাবে এ দুই ধরনের ভোজ্যতেলের বাজার মূল্য ছিল যথাক্রমে পাম তেলের জন্য প্রায় ২৬ কোটি ডলার এবং সয়াবিন তেলের জন্য ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত তিন বছরে (২০২৩, ২০২২, ২০২১) মোট তেল আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১০৬ মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য ১৫৭ কোটি ডলার।
অর্থাৎ এস আলম গ্রুপ শুধু আমদানি বাণিজ্যেই গড়ে বছরে ২০০ কোটি ডলারের মতো বিনিয়োগ করে আসছে। এস আলম গ্রুপ এককভাবে বর্তমান অভ্যন্তরীণ মোট বাজার চাহিদার পরিসংখ্যানে চিনি ৩৫ শতাংশ, তেল ৩০ শতাংশ ও গম ২০ শতাংশ পূরণ করে থাকে।
এর বাইরে গত পাঁচ বছরে এই গ্রুপটি দেশের চাহিদা পূরণে ৯৮ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ, ৫৫ হাজার ও ৪৮ হাজার মেট্রিক টন ছোলা আমদানি করেছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে এই গ্রুপের ছয়টি ভোজ্যতেল শোধনাগার এবং দুটি সক্রিয় চিনি শোধনাগার রয়েছে। আরও একটি চিনি শোধনাগার নির্মাণাধীন। স্ব-অর্থায়নে নির্মিত এসব শোধনাগারে অত্যাধুনিক মানসম্পন্ন ইউরোপীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল এবং ৫ হাজার ১০০ মেট্রিক টন চিনি পরিশোধন করা হয়। একটি মেগা চিনি শোধনাগারের নির্মাণকাজ ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে।
এসব ব্যবসায় এস আলম গ্রুপ লব্ধিত অর্থ লেনদেন থেকে সরকার বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার (১২ হাজার কোটি টাকা) রাজস্ব আদায় করে থাকে। দেশে এই গ্রুপের সম্মিলিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৯১০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা।
শুধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই এ গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে ২২৬ কোটি ডলার। এস আলম গ্রুপ গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সাফল্যজনক বিনিয়োগের জন্য চায়না-বাংলাদেশ বিজনেস এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০২৩ অর্জন করে।
এ গ্রুপের এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট বাংলাদেশে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীতে স্থাপিত এ প্রকল্পের দুটি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। প্রকল্পটিতে এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশ শেয়ার বা প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে সেপকো ২০ শতাংশ ও চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান এইচটিজি ১০ শতাংশের মালিক। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে এ গ্রুপের আরও ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের তালিকায় রয়েছে ‘গ্রিন ও রিনিউয়েবল এনার্জি’ প্রকল্প।
এ গ্রুপের শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রায় ৪০ হাজারের অধিক জনবল প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত রয়েছে। বার্ষিক টার্নওভার ও বিনিয়োগ বিবেচনায় দেশের ব্যাংকের আকার অনুযায়ী একক বা দুই-তিনটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ বিশাল ব্যবসায় তারল্য (চলতি মূলধন) জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য পাঁচ থেকে ছয়টি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলতি মূলধনের জোগান দরকার হয়। একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েই ব্যবসা করে। এটি একটি চেইন। এতে ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানটিরও মুনাফা হয় এবং তাদের সংশ্লিষ্ট জনবলও পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারে। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগ এবং আয়-ব্যয় ও ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার বিবেচনায় নিলে হিসাবের বাইরে কোনো অর্থ নেই বা কোনো রকমের অর্থ অন্যত্র সরানো হয়নি।