দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট এবং হরিপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ লক্ষ্যে কুমিল্লার বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনতে নারায়ণগঞ্জ জেলার মেঘনাঘাট হয়ে হরিপুর পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণকাজ চলছে। ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পটি চালু হলে এটি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট ও হরিপুর এবং মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াসহ আশপাশের বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প-কারখানাগুলোতে বাড়তি গ্যাসের চাহিদা পূরণে যুগান্তকারী অবদান রাখবে। যা দেশের অর্থনীতিতে যোগ করবে এক নতুন দিগন্তের। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় জামালদীতে মেঘনা নদীর কোল ঘেঁষে গ্যাসভিত্তিক ৬৬০ মেগাওয়াটের নতুন আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩০৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হবে ৫১২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। বাকি ৭৯২ কোটি ৩ লাখ টাকার জোগান দেওয়া হবে সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে মেয়াদ ও প্রকল্পের খরচ কিছুটা বাড়তে পারে।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মেঘনাঘাট পাওয়ার হাব এলাকায় বেসরকারি খাতে নির্মিত/নির্মিতব্য মোট ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া গজারিয়া, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাব এলাকায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেও গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এর ফলে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়বে এবং কমে আসবে লোডশেডিং।
সরেজমিনে প্রকল্পটির গজারিয়া অংশ ঘুরে দেখা যায়, ভবেরচর ইউনিয়নের আলীপুরা ও নয়াকান্দি এলাকায় সঞ্চালন লাইন বসানোর কাজ চলছে। প্রকৌশলীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পাইপ বসানোর কাজ করছে শ্রমিকরা। তবে প্রকল্পটির জন্য অধিগ্রহণ করা জমির দাম পাওয়া নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাকির হোসেন বলেন, ‘যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তারা আমাদের কাছে আবেদন করেছেন। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই চলছে, শিগগিরই তারা ক্ষতিপূরণ পাবেন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
পাওয়ার প্ল্যান্ট বিশেষজ্ঞ জালাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় জামালদীতে মেঘনা নদীর কোল ঘেঁষে গ্যাসভিত্তিক ৬৬০ মেগাওয়াটের নতুন আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-মালেশিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চারে নির্মাণ করা হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস/এলএনজি জ্বালানির উৎস হিসেবে আনুমানিক ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন বসানো হবে যা জিটিসিএলের মাধ্যমে নির্মাণাধীন ৪২ ইঞ্চি বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আমরা এই লাইনটির জন্য অপেক্ষা করছি। এই এলাকার সব বিদ্যুৎকেন্দ্র এ লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।’
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৬০ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও আরও কিছুটা সময় দরকার। আমরা সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি। আশা করছি আগামী বছর জুনের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে।’
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কারিগরি কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আমাদের অনেক কারিগরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমাদের ৯টি নদী ক্রসিং করতে হচ্ছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। নদী ক্রসিং সবচেয়ে বড় সমস্যা, শুধুমাত্র মেঘনা নদীতেই দুই কিলোমিটার ক্রসিং আছে যা বিশাল চ্যালেঞ্জের। হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ (এইচডিডি) পদ্ধতিতে ৯টি নদী ক্রসিং করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ নিয়েও নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আমরা তা ওভারকাম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)-এর মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ডিভিশন) প্রকৌশলী আবু সাঈদ মাহমুদ বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই মেঘনাঘাট, হরিপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। এসব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা গেলে এখান থেকে অভাবনীয় সুফল মিলবে যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব রাখবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’
এদিকে গত ৩০ জুন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার ভেরিফাইড ফেসবুক আইডিতে এ বিষয়ে একটি পোস্ট করে জানিয়েছেন ‘২০২৫ সালের মধ্যে নতুন এই পাইপলাইনের নির্মাণকাজ শেষ হবে যা নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট ও হরিপুর এবং মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াসহ আশপাশের বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প-কারখানাগুলোতে বাড়তি গ্যাসের চাহিদা পূরণে যুগান্তকারী অবদান রাখবে।’