
সম্প্রতি দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনকৃত কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ার হিসেবে পরিচিত ‘জেড’ শ্রেণির কোম্পানিগুলোর শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) চলতি অর্থবছরের জন্য নতুন বিনিয়োগ নীতি ঘোষণা করেছে। নতুন বিনিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি এখন থেকে দুর্বল মৌলভিত্তির ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ার না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে আর কোনো শেয়ার বিক্রি করবে না, এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটির এই খবরে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ারে বড় পতন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ‘জেড’ শ্রেণির ৫৬টি কোম্পানির মধ্যে ৪৪টিরই দাম কমেছে, বেড়েছে মাত্র ৬টির, অপরিবর্তিত রয়েছে ৪টির এবং লেনদেন হয়নি ২টির।
বৃহস্পতিবারের ধারাবাহিকতায় বজায় রেখে রবিবারও (১৪ জুলাই) ‘জেড’ শ্রেণির ৪২টি কোম্পানির শেয়ারে দরপতন হয়। এদিন ‘জেড’ শ্রেণির কোম্পানির মাত্র ৯টি কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ে এবং অপরিবর্তিত থাকে ৩ কোম্পানির শেয়ারদর। গতকাল ডিএসইতে জেড শ্রেণির ৫৪ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২-৩ বছর যাবত আইসিবির বিনিয়োগ তলানিতে নেমে গেছে। তারপরেও পুঁজিবাজারের লেনদেনের ক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের উত্থান পতনে ভূমিকা রাখে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইসিবি একসময় দেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী ছিল। এখন নানা কারণে প্রতিষ্ঠানটি তার অবস্থান হারিয়েছে। তবে পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করলে প্রতিষ্ঠানটি তার হারানো অবস্থান ফিরে পেতে পারে।’ প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে প্রভাব রাখেও বলে জানান তিনি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইসিবি ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ার কিনবে না-এমন খবরে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ারের ঢালাও পতন হয়েছে। এর পেছনে কেবল বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্বিক কারণ নিহিত।
শহিদুল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী খবরের কাগজকে বলেন, বারবার ‘জেড’শ্রেণির শেয়ার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের নতুন নতুন সিদ্ধান্তের ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমার কাছে ‘জেড’ শ্রেণির ৪টি কোম্পানির শেয়ার রয়েছে। আমি যখন বিনিয়োগ করেছিলাম তখন এ কোম্পানিগুলো ভালো শ্রেণির শেয়ার ছিল। কিন্তু বিএসইসি, ডিএসই এবং সর্বশেষ আইসিবির সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিদিন পুঁজি হারাচ্ছি।
জেড শ্রেণির শেয়ার নিয়ে নানা নির্দেশনা: চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে পরপর ২ বছর যেসব কোম্পানি লভ্যাংশ দেয়নি এমন কোম্পানিগুলোকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি পরপর দুই বছর লভ্যাংশ ঘোষণায় ব্যর্থ হলে তাকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে। একই সঙ্গে টানা দুই বছর বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম করতে ব্যর্থ হলেও কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানো হবে। তবে এজিএম অনুষ্ঠিত না হওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনো রিট পিটিশন বা আদালতে বিচারাধীন কোনো আইনি প্রক্রিয়া থাকে তাহলে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ বছরের জন্য বিবেচনা করা হবে।
এ ছাড়া উৎপাদনহীন কোম্পানি নিয়েও কড়া নির্দেশনা দিয়েছে বিএসইসি। এখন থেকে কোনো কোম্পানি টানা ৬ মাস তার কার্যক্রম পরিচালনা থেকে বিরত থাকলে বা উৎপাদন বন্ধ রাখলে সেটিকেও ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে। পাশাপাশি কোনো কোম্পানির টানা দুই বছর ক্যাশ ফ্লো বা নগদ প্রবাহ নেতিবাচক আসলে এবং পরিশোধিত মূলধনের থেকে ঋণ বেশি হলে তাকেও স্থান দেওয়া হবে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কোনো কোম্পানি সিকিউরিটিজ আইন, বিধি-বিধান, বিজ্ঞপ্তি, আদেশ কিংবা নির্দেশাবলী পালনে ব্যর্থ হলে বা অসম্মতি জানালে সেটিকেও কমিশনের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে ‘জেড’ শ্রেণিতে স্থানান্তর করা হবে।
বিএসইসির এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসই চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তালিকাভুক্ত ২২ কোম্পানির শেয়ারকে আগের ‘এ’ বা ‘বি’ শ্রেণি থেকে অবনমন করে ‘জেড’ শ্রেণিতে নিয়ে যায়।
তবে লভ্যাংশ ইস্যুতে কোনো কোম্পানিকে তখনই ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করার অনুমতি দেয়নি বিএসইসি।
ডিএসইর এ সিদ্ধান্তের ফলে তখন দেশের পুঁজিবাজারে বড় পতন হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, এখন থেকে আর কোনো কোম্পানি জেড শ্রেণিভুক্ত হবে না। তারপরেও চলতি বছরের মার্চ মাসে ডিএসই তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্য থেকে আরও ৬টি কোম্পানিকে নতুন করে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে ‘এ’ বা ‘বি’শ্রেণি থেকে হঠাৎ করে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করার ফলে এ কোম্পানিগুলোর শেয়ার তখন মার্জিন ঋণ নিয়ে কেনা যায় নাই। আইন অনুযায়ী ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত শেয়ার মার্জিন ঋণ নিয়ে কেনা যায় না। ফলে পুঁজিবাজারে পতন ঘটে। কারণ যে প্রতিষ্ঠানগুলো এই কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনার জন্য মার্জিন ঋণ দিয়েছিল তারা ফোর্স সেল করে তাদের বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়। এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চলতি বছরের মে মাসে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের বিষয়ে আবার বেশ কিছু শর্ত দিয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি।
বিএসইসির জারিকৃত নির্দেশনায় বলা হয়, শর্তগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি শর্ত লঙ্ঘন করলে ডিএসই ও সিএসই ওই কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করতে পারবে।
বিএসইসির নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানি শেষ ডিভিডেন্ড ঘোষণার তারিখ থেকে বা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির তারিখ থেকে পরপর দুই বছরের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে ব্যর্থ হলে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে।
এর পাশাপাশি আইন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করতে ব্যর্থ হলেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে কোনো রিট পিটিশন বা আদালতে বিচারাধীন কোনো আইনি প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ এজিএম অনুষ্ঠিত না হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থাৎ উপ-বিচারের বিষয় বা জোরপূর্বক ঘটনা ঘটলে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ বছর সময় পর্যন্ত বিবেচনা করা যেতে পারে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, যদি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংস্কার বা বিএমআরই (ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন এবং সম্প্রসারণ) এর জন্য এই ধরনের কোনো সময় ব্যতীত ন্যূনতম ছয় মাস ধরে একটানা উৎপাদনে না থাকলে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে।
এ ছাড়া পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছাড়িয়ে গেলে ওই কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা যাবে।
এ ছাড়া কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঘোষিত বা অনুমোদিত ডিভিডেন্ডের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ পরিশোধ বা বিতরণ করতে ব্যর্থ হলে স্টক এক্সচেঞ্জ তা ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করতে পারে।
ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান ছাড়া ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত অন্য কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকদের শেয়ার লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।