গরম এলেই মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে পাওয়ার আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে। আর গরম থেকে স্বস্তি পেতে ছোট-বড় সবারই দোকানে দোকানে চাওয়া থাকে আইসক্রিম। এখন নামিদামি অনেক ব্র্যান্ডের আইসক্রিমে সাজানো থাকে দোকানের ফ্রিজগুলোতে। সেই আইসক্রিমের বাজার এখন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, আর বছরে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কাছাকাছি।
কোভিড-১৯-এর প্রভাবে প্রায় দুই বছর আইসক্রিমের ব্যবসায় মন্দা থাকলেও গত তিন চার বছরে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে আইসক্রিম শিল্প। এই শিল্পের বিকাশে অনেক সংকট আছে এমন মন্তব্য শিল্প সংশ্লিষ্টদের। তারপরও তাদের প্রত্যাশা আগামী বাজেটে এ শিল্পের বিকাশে থাকবে সুস্পষ্ট নীতি-সহায়তা।
দেশের আইসক্রিমের বাজারের দুই-তৃতীয়াংশের দখল রয়েছে আব্দুল মোনেম গ্রুপের ইগলু ও ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের পোলার ব্র্যান্ডের। এ ছাড়া লাভেলো, স্যাভয়, বেলিসিমো, জা এন জি, ব্লুপ, কোয়ালিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত আইসক্রিম বাজারজাত করছে।
দেশের আইসক্রিমের বাজার কে কতটা দখলে রেখেছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি বাজারসংশ্লিষ্টরা। তবে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বর্তমানে দেশের আইসক্রিমের বাজারের আকার আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৫ সালে এটি বেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। প্রতিবছর দেশের আইসক্রিম শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। মূলত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে আইসক্রিম বিক্রির মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে মার্চ থেকে জুনকে বলা হয় সুপার পিক এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরকে সেমি-পিক সিজন হিসেবে গণ্য করা হয়।
বেসরকারি আইসক্রিম প্রতিষ্ঠানের সম্প্রতি একটি গবেষণায় জানিয়েছে, ২০২১ সালে দেশের আইসক্রিমের বাজার আগের বছরের তুলনায় ৯৩ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৪১০ কোটিতে পৌঁছেছে। ২০২০ সালে দেশের আইসক্রিমের বাজার ছিল ৭৩০ কোটি টাকার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সাল শেষে এই শিল্পের বাজার ২ হাজার ৬০০ কোটিতে ছাড়িয়ে যাবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আইসক্রিম তৈরির বেশির ভাগ কাঁচামাল আমদানি করে নিয়ে আসতে হয়। দেশীয় উৎস থেকে শুধু চিনি, বাটার ও পানি সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া চকলেট, মিল্ক ফ্যাট, ফুল ক্রিম দুধ, ফ্লেবারসহ অন্যান্য উপাদান আমদানি হয়। আর এসব পণ্য ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
সম্প্রতি আব্দুল মোনেম লিমিটেডের পরিচালক যায়নাব মাইনুদ্দিন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় জানিয়েছেন, আইসক্রিম একটি স্পর্শকাতর তাপমাত্রা সংবেদনশীল পণ্য। তাই এর উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন ও বাজারজাতের প্রতিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত জনবলের নির্দিষ্ট কোনো প্রশিক্ষণ নীতিমালা নেই।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজাটে আইসক্রিম খাতের জন্য সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল ও মেশিন আমদানির জন্য পৃথক এইচএস কোড নির্ধারণ করা জরুরি। এ ছাড়া আইসক্রিমের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চ শুল্কহারের পরিবর্তে ব্যবসাবান্ধব শুল্কহার ঘোষণা করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘আইসক্রিম বিক্রি করতে সেলস জেনারেটিং অ্যাসেট (এসজিএ) অর্থাৎ প্রয়োজন ফ্রিজার। বর্তমানে ডিপ ফ্রিজে আমদানির ওপর ১০৪ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। দেশের বাজারে উন্নতমানের কমার্শিয়াল ফ্রিজার উৎপাদন হচ্ছে না। তাই ভ্যাট রেজিস্টার্ড আইসক্রিম উৎপাদন শিল্পের জন্যে ফ্রিজার আমদানির ওপর শুল্ক কমানো জরুরি।’
আইসক্রিম একটি দুগ্ধজাত পণ্য। দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে খুবই প্রয়োজনীয়। বিশেষ তাপমাত্রা বজায় রেখে উৎপাদন ও বিক্রি করতে হয় বলে খরচও অনেক বেশি। তাই আইসক্রিম বিক্রির ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
দেশের আইসক্রিম কোম্পানিগুলোর মধ্যে সরাসরি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি। এ ছাড়া গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এই কোম্পানির একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে গোল্ডেন হার্ভেস্ট আইসক্রিম লিমিটেড।
তাওফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি ইতোমধ্যে তাদের চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে।
এ বিষয়ে কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মহিউদ্দিন সরদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ সময়টিতে মূলত আইসক্রিমের চাহিদা বাড়ে। এ জন্য স্বাভাবিকভাবেই আয় বেড়েছে। আমাদের নতুন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, আগামীতে আইসক্রিম বিক্রির মাধ্যমে আয় বাড়ানো সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটি তাদের দ্বিতীয় আইসক্রিম উৎপাদন কারখানা স্থাপনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় বিদ্যমান উৎপাদন কারখানাসংলগ্ন ৫৯.১৬ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে নতুন কারখানা স্থাপনে।
কোম্পানিটি সূত্রে জানা গেছে, নতুন কারখানায় উৎপাদন শুরু হওয়ার পর দৈনিক ২ লাখ ৫০ হাজার লিটার আইসক্রিম উৎপাদন হবে, এটি লাভেলোর বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। প্রকল্পটি ২০২৫ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। কোম্পানিটির দ্বিতীয় প্রান্তিকে নিট মুনাফা করেছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা হয়েছিল ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
দেশের বাজারে ব্লুপ ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বাজারজাত করছে গোল্ডেন হার্ভেস্ট আইসক্রিম লিমিটেড। গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কোম্পানি সচিব ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আইসক্রিম ফ্যাক্টরিটি সুইডেনের টেট্রা প্যাকের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়েছে। এটি ডেনিশ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। ব্লুপ ব্যান্ডটি প্রায় ৪০টি বিভিন্ন ধরণের পণ্য বাজারে সরবরাহ করছে। এর মধ্যে আছে আইসক্রিম স্টিক, কাপ, কোন, ক্যালিপ্পো, শরবত, টাব, কেক অন্যতম।
অতি সম্প্রতি আইসক্রিম শিল্পের ওপর করা লংকাবাংলা গ্রুপের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে বছরে ৬ কোটি লিটারের বেশি আইসক্রিমের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার পুরোটাই যোগান দিচ্ছে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা। এখন আলোচনায় আছে দেশ থেকে আইসক্রিম রপ্তানি’। জরিপে বলা হয়েছে, মোট চাহিদার ৩৮ শতাংশ যোগান দিচ্ছে আবদুল মোনেম লিমিটেডের ব্র্যান্ড ইগলু। ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের পোলার চাহিদার ২৮ শতাংশ যোগান দিচ্ছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে লাভেলো। প্রতিষ্ঠানটি মোট চাহিদার ১৫ শতাংশ উৎপাদন করেছে। কোয়ালিটি রয়েছে চতুর্থ পর্যায়ে, কোম্পানিটি বছরে মোট চাহিদার ৯ শতাংশ যোগান দিচ্ছে। বাকি ১০ শতাংশের যোগান দিচ্ছে জা এন জি, ব্লুপ, স্যাভয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।
আইসক্রিম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানসম্মত আইসক্রিমে অন্তত ১২ শতাংশ মিল্ক ফ্যাট থাকা প্রয়োজন। এই পণ্যের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় তরল দুধ, গুঁড়ো দুধ, দুগ্ধজাত ক্রিম, কনডেন্সড মিল্ক, ভেজিটেবল ফ্যাটসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত ও চর্বিযুক্ত উপকরণ। এ সবের একটি বড় অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, বিশেষত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, স্পেন, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে। স্বাদ ও গন্ধ বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত উপাদান যেমন ফলের নির্যাস, চায়ের আস্তরণ, কোকো পাউডার, বাদাম, নারকেলের নির্যাস ও চকলেট কোটিং- এসবও আমদানি করা হয় মালয়েশিয়া, চীন, স্পেন ও ফ্রান্স থেকে। এ ছাড়া, আইসক্রিম মোড়কজাত করতে যে বিশেষ ধরনের র্যাপার ব্যবহৃত হয়, তা আসে থাইল্যান্ড, চীন ও তুরস্ক থেকে।