বিদায়ী অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় ১১০ প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় হয় ৭৩ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায়কৃত মোট ভ্যাটের ৪৯ শতাংশই এসেছে এসব বড় প্রতিষ্ঠান থেকে।
শুধু গতবারই না, এর আগের অর্থবছরেও ভ্যাট আদায়ের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। বড় ১১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিগারেট, ঠিকাদার, নির্মাণপ্রতিষ্ঠান, তেল-গ্যাস কোম্পানি ও মোবাইল ফোন কোম্পানি রয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ২০ লাখ ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান থাকলেও এ পর্যন্ত অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে গড়ে ৪ লাখের বেশি প্রতিষ্ঠান।
প্রতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে তা পূরণে এনবিআরকে চাপ দেওয়া হয়। এনবিআর ভ্যাটের আওতা বাড়াতে চেষ্টা করলেও আশানুরূপ নয়। ঘুরেফিরে যারা ভ্যাট দেয়, তাদের ওপরই বাড়তি পরিশোধের চাপ দেওয়া হয়।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে,বড় ১১০ প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি ভ্যাট আহরণ হয়। বিশেষজ্ঞরাও একই মত জানিয়েছেন।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যারা নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করছি, তাদের ওপরই চাপ বেশি আসে। এতে করে নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধকারীরা বিপাকে পড়েন। আমাদের দাবি, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সব ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা হোক।’
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিক্রেতারা ভ্যাট যোগ করে পণ্যের মূল্য হিসেবে কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে। অথচ কিছু অসাধু বিক্রেতা আদায়কৃত ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের পকেটে রেখে দেয়। অনেকে আবার নামমাত্র কিছু জমা দেয়। অন্যদিকে বড় মাপের কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বারবার চাপ দিয়ে ভ্যাট আদায় করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার নিজের থেকেই ভ্যাট পরিশোধ করে। তাই ঘুরেফিরে এসব বড় প্রতিষ্ঠানই আদায়কৃত ভ্যাটের বেশির ভাগ পরিশোধ করে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, প্রতিবছরই এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। এনবিআর যেভাবে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে, সেভাবে ভ্যাটের আওতা বাড়াতে পারেনি। তাই লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলে যারা ভ্যাট পরিশোধ করছে তাদের ওপরই চাপ বাড়ছে।
বার্ষিক লেনদেন ১০ কোটি টাকার বেশি হলে এনবিআরের এলটিইউ (ভ্যাট) শাখা ওই প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট আদায় করে। বর্তমানে ১১০ প্রতিষ্ঠান আছে এলটিইউতে।
এলটিইউর (ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশিদ মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, এবারে এলটিইউ থেকে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ভ্যাট আদায় করা হয়েছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করায় আদায় বেড়েছে। এ ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) থেকে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পেট্রোবাংলা থেকে তুলনামূলক বেশি ভ্যাট পাওয়া গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট আদায় হয়েছে সিগারেট খাত থেকে, ৩৫ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ ভ্যাট প্রদান করেছে ৩৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) ২ হাজার ২৮০ কোটি টাকা দিয়েছে। চার মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক এবং টেলিটক থেকে রাজস্ব পাওয়া গেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। পেট্রোবাংলা ভ্যাট পরিশোধ করেছে ৯ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।
ভ্যাট আদায়ে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে আছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দেশের ২৫ হাজার ৩০৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে গত অর্থবছরে ১৬ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধের সময় ভ্যাট কেটে রাখা হয়। ছয়টি তেল-গ্যাস কোম্পানি ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা দিয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট আদায়কৃত ভ্যাট ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০৯ প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ৫৮ হাজার ৫৬৬ টাকা, যা আদায় করা ভ্যাটের ৪৭ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আদায়কৃত ভ্যাট ১ লাখ ৩০০ কোটি টাকা। বড় মাপের ১১০ প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৫৩ শতাংশ পরিশোধ করেছে, ৫২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। ১১০ প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ভ্যাটের অর্ধেকের বেশি এসেছে সিগারেট খাত থেকে, ২৭ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।
এনবিআর ভ্যাট বিভাগের সদস্য মইনুল খান খবরের কাগজকে বলেন, এনবিআর ভ্যাট আদায়ের আওতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে ভ্যাটের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হিসাবমতো আদায়ে জোর বাড়িয়েছে। গত অর্থবছরে এনবিআর রেকর্ড ভ্যাট আদায় করেছে। আশা করি আগামীতেও ভ্যাট আদায়ের সফলতা আসবে।