নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমছে না। বরং বেড়েই চলছে। সদ্য বিদায় নেওয়া শেখ হাসিনার সরকার একদিকে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দিয়েছে, অন্যদিকে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নেওয়া হয়েছে একের পর এক নীতি। এর পরও আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কমেনি। বরং বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে তিন মাসের ব্যবধানে জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা বা ১৬ শতাংশ। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বর্তমানে তা দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত ঋণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ হলো ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত মার্চে এ হার ছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত ঋণ ও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক জুন প্রান্তিক শেষের এ খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে।
ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা অবশ্য মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ও আদালতের আদেশে স্থগিত থাকা ঋণ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে ৯টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাংকগুলোকে নানা নির্দেশনাও দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র আগামী দিনে বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। মার্চ শেষে এ হার ছিল ২৭ শতাংশ। এই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর ৩৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বা ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ মার্চ শেষে ছিল ১২ লাখ ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। অপরদিকে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা বা মোট খেলাপি ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। মার্চ শেষে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত ঋণ ও বিনিয়োগ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। তখন এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ ৩ হাজার ২২৯ বা ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মার্চ শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ ৬৬ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ছিল ৫ দশমিক ২০ শতাংশ।
২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত জুন শেষে ব্যাংক খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশই খেলাপি।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে তালিকার শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক, যাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার বলেন, ‘আমরা কোনো কিছু গোপন করছি না। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এত বেড়ে গেছে। খেলাপি হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগও করছি। তারা টাকা জমা দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করার চেষ্টা করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিপত্রে দেখা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ দিয়েছে, তার একটি শর্ত হচ্ছে ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে গত ১৫ বছরে ঋণখেলাপিদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। একদিকে বিশেষ বিশেষ গ্রাহককে বেশি ঋণ দিতে আইন শিথিল করা হয়েছে, অন্যদিকে আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে খেলাপিদের ঋণ দিতে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে। ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
এরপর কোভিড মহামারি শুরু হলে সব ধরনের গ্রাহককে ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দিয়ে ঋণ খেলাপিদের ঢালাও ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা জারি করেন। আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আগে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ ৫ থেকে ৮ বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।