ফেনীর বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যার কারণে ৪৯ হাজার মোটরসাইকেল ও ৮ শতাধিক প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গাড়ির মেরামতে মালিকদের গুনতে হচ্ছে প্রায় ৬১ কোটি টাকা। গাড়ি মেরামত সংশ্লিষ্ট ফেনীর একাধিক গ্যারেজ মালিক ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। খবর বাসসের।
ফেনী শহরের একাধিক মোটরসাইকেল মেরামত প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে মোটরসাইকেল মালিকরা সেখানে ভিড় করছেন। কামাল অটো সার্ভিসের মিজান রোড এবং কোর্ট বিল্ডিং এলাকার গ্যারেজে বন্যার পানিতে ডুবে ত্রুটিপূর্ণ বেশকিছু মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
এবারের বন্যায় জেলায় ৪৯ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল পানিতে ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন কামাল অটো সার্ভিসের মালিক কামাল হোসেন। মোটরসাইকেল মেরামতে দক্ষ হিসেবে পরিচিত এ ব্যক্তি জানান, তার দুটি গ্যারেজে গত এক সপ্তাহে ২ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের ত্রুটি সারানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মোটরসাইকেলের সংখ্যার বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন নবী অটো নামীয় প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. নূর নবী এবং আরেক মেকানিক মাইনউদ্দিন।
অন্যান্য ওয়ার্কশপের মধ্যে আবদুল ট্রেডার্স, ফারিয়া ওয়ার্কশপে ঘুরে ত্রুটিপূর্ণ মোটরসাইকেলের বিশাল সারি লক্ষ করা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের তথ্যানুযায়ী, গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাড়ির গতি নির্ণয়ক মিটার। তারা জানান, সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মোটরসাইকেল মেরামতে মালিকদের গুনতে হচ্ছে। গড় হিসেবে গাড়িপ্রতি ১০ হাজার টাকা মেরামতে ব্যয় হচ্ছে। এ হিসেবে উল্লিখিত মোটরসাইকেল মেরামতে মালিকদের গুনতে হচ্ছে ৪৯ কোটি টাকা।
নূর নবী জানান, মোটরসাইকেল সার্ভিসিংয়ের জন্য ফেনী শহরে ৪০টি ওয়ার্কশপসহ জেলায় মোট ৯৬টি ওয়ার্কশপ রয়েছে। প্রায় ৮০ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল এসব গ্যারেজে সার্ভিসিং করা হয়ে থাকে। এসব মোটরসাইকেলের সব ফেনীসহ আশপাশের উপজেলায় চলাচল করে। এসব এলাকার প্রায় শতভাগ বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে।
জেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, এবারের বন্যায় পানি দ্রুত ও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ঘরবাড়ি বন্যায় তলিয়ে গেছে। ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্রের মতো মোটরযানও পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। শহরের অধিকাংশ ভবনের গ্যারেজ পানিতে ডুবে গেছে। ফলে যেসব গাড়ি সেসব স্থানে রাখা ছিল তা বন্যার পানিতে ডুবে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
একইভাবে বন্যার পানি প্রবেশ করে ৮ শতাধিক প্রাইভেট কার এবং মাইক্রোবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্কশপ মালিক ও ভুক্তভোগী। এসব গাড়ির বড় একটি অংশ ফেনীর গ্যারেজগুলোয় মেরামত করা হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে মোটর মেকানিকরা এসে ফেনীতে কাজ করছেন। কিছু গাড়ি ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিয়ে মেরামত করা হচ্ছে। মোটর মেকানিক ও গাড়ি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাড়ি প্রতি সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা মেরামতে ব্যয় হচ্ছে। গড় হিসাবে তারা বলছেন, গাড়িপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ হিসাবে বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস মেরামতে মালিকদের গুনতে হচ্ছে ১২ কোটি টাকা।
বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাইভেট কার মালিক আলম জানান, তার টয়োটা প্রিমিও ২০১৮ মডেলের প্রাইভেট কারটি বন্যার পানিতে প্রায় চার দিন নিমজ্জিত ছিল। মেরামত করতে গিয়ে দেখা গেছে দরজার অটোলক, ডায়নামো, মোটর, সার্কিটসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ পানিতে ভিজে অকেজো হয়ে গেছে। গাড়িটি মেরামতে আড়াই লাখ টাকা খরচ হবে বলে ওয়ার্কশপ থেকে জানানো হয়েছে। এ সুযোগে গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মোটরপার্টস ব্যবসায়ীরা। তিনি আরও জানান, ফেনীতে হাজারের বেশি গাড়ি ভাড়ায় চালিত। এসব গাড়ির বড় একটি অংশ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফেনীর বিভিন্ন ওয়ার্কশপে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার পর্যন্ত মহাসড়কের রামপুরে রাকিব ওয়ার্কশপে ৩০টি, হযরত পাগলা মিয়া সড়কে শরীফ অটোমোবাইলে ৪০টি, মক্কা অটোতে ১০টি, শাহীন অটোমোবাইলে ৯টি, পলিটেকনিক সংলগ্ন ইসমাইল অটোতে ৩৫টি প্রাইভেট কার এবং মাইক্রোবাস মেরামতের জন্য আনা হয়েছে। ওয়ার্কশপ মালিকদের তথ্যমতে, ফেনী জেলায় শতাধিক অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ রয়েছে। এসব সার্ভিসিং সেন্টারে ফেনী ছাড়াও আশপাশের অন্য উপজেলা থেকে গাড়িগুলো এখানে সেবা নিয়ে থাকে।
অতিবৃষ্টি এবং ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফেনীর উত্তরাঞ্চল তিনবার বন্যা আক্রান্ত হয়। গত ১৯ আগস্ট তৃতীয় দফায় বন্যার ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জেলা প্রশাসন সূত্রমতে, জেলার ৯৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় আক্রান্ত হয়। দুর্ভোগে পড়েছে ফেনীর ১০ লক্ষাধিক মানুষ। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও কৃষি খাত।