নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ২০০ বছরের পুরনো কাইকারটেক হাট বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সংস্কারের অভাবে কালের বিবর্তনে হাটটি আকর্ষণ হারাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ৫০ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত এই হাট সিন্ডিকেটের দখলে থাকার কারণে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা কমেছে। সোনারগাঁসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, দাউদকান্দি ও মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দারা এখানে পণ্য কেনা-বেচা করেন। ঈদুল আজহার সময় এটি নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় পশুর হাট হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর হাটটির কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। প্রতি রবিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।
জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা কিছুর পসরা সাজিয়ে বসেন এই হাটের দোকানিরা। এখানে মাছ ধরার সামগ্রী, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর, খাল ও নদীর মাছ, কাস্তে, দা, বঁটি, কুড়াল, জামা-কাপড়, কলমের গাছসহ নিত্যব্যবহার্য নানা কিছু বিক্রি হয়। মৌসুমি নানা ফল যেমন- আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ও খাবার জিনিস থেকে শুরু করে ঘরে বানানো আসবাবপত্রও এখানে পাওয়া যায়।
ঐতিহ্যবাহী এই হাটের নৌকার কেনাবেচার ইতিহাস বহু বছরের পুরোনো। এই হাটের নৌকার খ্যাতি এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে গেছে। তাই বছরজুড়ে হাট বসলেও আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এই চার মাস কম দামে ভালো মানের নৌকা কেনার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত ক্রেতার আগমন ঘটত।
হাটের মজার মজার খাবারগুলোও আগন্তুকদের মুগ্ধ করে। ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাটের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি। ওই মিষ্টি ওজন ও পরিমাপে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় চার থেকে পাঁচগুণ বড়। এর ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়ে থাকে। ই মিষ্টির নাম ‘পুতা মিষ্টি।’ এই হাটে অনেকে শুধু পুতা মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসেন। পুতা মিষ্টি ২০০-৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এ ছাড়া তালের রস, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহসহ নানা ধরনের মিষ্টি এবং দই, পরোটা-ভাজি, ডালসহ নানা পদ পাওয়া যায়। এখানে টকদই, আখের গুড় দিয়ে বানানো লাচ্ছি, ঝালমুড়ি, মুরালি, বুট, পেঁয়াজু, নিমকি, চানাচুর, মোয়াসহ নানা ধরনের খাবার বিক্রি হয়। মাছের শুঁটকিও এখানের বিশেষ আকর্ষণ, বিশেষ করে চ্যাপা ও ইলিশ শুঁটকি।
কিন্তু শত বছরের পুরোনো এই হাটটির পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা, শৌচাগার ও সিন্ডিকেটের দখলে থাকার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সুলভমূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সুবিধা কম থাকায় আগের মতো ক্রেতা আসছেন না। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলবাজি ও ভূমিদস্যুদের নজরে পড়েছে এ হাট।
মো. দেলোয়ার হোসেন নামের এক কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, ‘কাইকারটেক হাট এখন আর আগের মতো নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ। রাস্তাঘাট ও সিন্ডিকেটের দখলে থাকায় সস্তা কিংবা সুলভমূল্যে পণ্য কিনতে মানুষ এলেও এখন তেমন সুলভমূল্যে পণ্য বিক্রি করা যায় না। ফলে ক্রেতারা আগের মতো আসছেন না।’
৮১ বছর বয়সী শরবত বিক্রেতা মজিবুর রহমান বলেন, ‘এই কাইকারটেক হাটে আমি পাকিস্তান আমল থেকে আসছি। ৬৫ বছর ধরে শরবত বিক্রি করছি। বয়স হয়ে যাওয়ায় আমার ভাগিনা আশরাফ উদ্দীন আমাকে সঙ্গ দেন। আমাদের শরবত দীর্ঘদিনের নামডাক পাওয়া। দূর-দূরান্ত থেকে যারা এই হাটে বাজার করতে আসেন, তারা আমাদের শরবত না খেয়ে যেতেন না। কিন্তু এখন তেমন লোক আসেন না, তাই ব্যবসার অবস্থাও ভালো ন।’
মাছ ধরার জাল বিক্রি করা মুসা মিয়া বলেন, ‘আমার দাদার আমল থেকে এই হাট বসে। এখানে জিনিসপত্র খুবই সস্তায় পাওয়া যেত। তবে পরিস্থিতির কারণে দাম স্থানীয় বাজারের মতো হওয়ায় বর্ষাকাল ব্যতীত তেমন বিক্রি হয় না।’
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান বলেন, ‘২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাটটির উন্নয়নমূলক কাজ শিগগির শুরু করা হবে। হাটটি সংস্কার করা হলে ফিরে পাবে হারানো যৌবন।’