কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সম্প্রতি গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভারে শ্রম অসন্তোষের কারণে গত দুই মাসে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আদেশ কমপক্ষে ১০-১৫ শতাংশ বাতিল হয়ে গেছে।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এসব এলাকায় ৪০৮টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে শ্রম অসন্তোষে ৪০-৬০টি বন্ধ হয়েছে।
পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প খাতে সাম্প্রতিক শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘শ্রম অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা যাচ্ছে। তাই যেভাবে হোক শ্রম অসন্তোষ নিষ্পত্তি করতে হবে।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব আরও বলেন, ‘বিশেষ সময়ে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের দাবি বাড়ছে। স্থানীয়ভাবে ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। আমরা এসব বিষয়ে সজাগ আছি এবং প্রতিনিয়ত সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বেতন না দেওয়াকে কেন্দ্র করে হেমায়েতপুর-সাভার মহসড়কে ভাঙচুর হয়েছে। এখানে অনেক গ্রুপ কাজ করছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আন্তসভা হয়েছে। শ্রম অসন্তোষ নিরসনে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি। সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’ সভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা অবিলম্বে পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণসহ আটটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিকের আস্থা ফিরিয়ে আনা হবে
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে যে কমিটিগুলো আছে, সেগুলো বিভিন্ন কারণে বিগত সরকারের আমলে শ্রম অধিদপ্তর ও শ্রম আদালতের ওপর শ্রমিকরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। সেটা কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, আপাতত শ্রমিকরা যে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছেন, তাদের দাবিগুলো যাতে কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা যায় সে জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। তৈরি পোশাক এবং তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতে শ্রম অসন্তোষ ও শ্রম পরিস্থিতির বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে শ্রম অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং শ্রম অধিদপ্তরের ট্রেড ইউনিয়ন ও সালিশির পরিচালককে সদস্যসচিব করে এ কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে তিনজন শ্রমিক নেতা, দুজন সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী এবং মালিকপক্ষের দুজন সদস্য আছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে শ্রম ভবন আছে সেখানে শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করেন। কমিটি পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার কাছে পাঠাবে। শ্রমিকদের যে ন্যায্য দাবিগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে যেটা স্বল্প মেয়াদে বা দ্রুত সমাধানযোগ্য, সেটা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’
শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধসহ ৮ সিদ্ধান্ত: শ্রম উপদেষ্টা বলেন, শ্রম অসন্তোষ নিরসনে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো- শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা অবিলম্বে পরিশোধ গ্রহণ করা, মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানাও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং যথাসম্ভব মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা, ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান কমিটিসমূহ পুনর্গঠনপূর্বক হালনাগাদ করা, শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটির কার্যক্রম দ্রুত শুরু এবং শ্রম অসন্তোষ-সংক্রান্ত শুনানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রতিদিনের মাঠপর্যায়ের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা, স্থানীয় পর্যায়ে শ্রম অসন্তোষ নিরসন কমিটি করে স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা। এ ছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন দ্রুত পরিশোধ এবং এ-সংক্রান্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা। ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা ইত্যাদি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। সংশ্লিষ্ট ছয়টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আন্তসমন্বয় সভা হয়েছে। আমরা এখানে কোনো গ্যাপ রাখতে চাচ্ছি না। সচিব পর্যায় থেকে সবাই সমন্বয় রাখবেন। যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া য়ায় এবং সমাধান করা যায়। সচিব এবং আমি নিজেও মাঠে যাব। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলব। সরকারের সঙ্গে শ্রমিকদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা কমিয়ে আনা হবে।
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শ্রম অসন্তোষ নিরসনে কাঠামোগত সংস্কার করা হবে। ২০২৩ সালে শ্রমিকের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তার তথ্য নেওয়া হচ্ছে। সেই মামলা প্রত্যাহারে আইন মন্ত্রণালয়ে কথা বলা হবে।
ঝুঁট ব্যবসায় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। ঝুঁট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হচ্ছে। তাই এর স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। যাতে আর কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে। শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ২৫ দফা দাঁড়িয়েছে। কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে দাবিগুলো উপস্থাপন করা হলে সমাধানের পথ বের করা হবে। কারণ শ্রমিকরা কখনো কারখানায় হামলা করেন না। বহিরাগতরা এটা করছে। তা দেখা হবে বলে জানান উপদেষ্টা।