গত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে একটি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মতান্ত্রিক কোনো খবরদারি চলেনি। বলা যায়, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সেখানে নিষিদ্ধ ছিল। ফলে নানাবিধ অনিয়ম হলেও ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল কোনো কাজ করতে পারেনি। দেশের প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকটি হলো ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি যা সংক্ষেপে আইএফআইসি ব্যাংক নামে পরিচিত।
২০০৯ সালে ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে ঢোকেন, কায়েম করেন একচ্ছত্র দোর্দণ্ড প্রতাপ। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরসহ ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সময়ে ধমক দিয়েছেন। সর্বশেষ তার ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান ব্যাংকটির পরিচালক ও ভাইস-চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাপ-বেটা মিলে আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে ব্যাংকটি থেকে নিয়ে গেছেন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
যেসব কোম্পানির বিপরীতে নিয়ম বহির্ভূত এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো হলো বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা ও বেক্সিমকো টেক্সটাইল। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটি থেকে গাজীপুরের শ্রীপুরে মায়ানগর টাউনশিপ আবাসন প্রকল্পের নামে সালমান আরও ঋণ নেন। এ ছাড়াও সাধারণ মানুষকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টেনে এনে তিনি বন্ড ও সুকুক ছেড়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সালমান এফ রহমান ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টের শুরু পর্যন্ত পর্ষদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তার এ দীর্ঘসময়ে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শাহ আলম সারওয়ার এই আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
গত ২৯ মে এমডির পদ থেকে অবসরে গেলে আলম সারওয়ারকে ব্যাংকটির ‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ হিসেবে নিয়োগ দেন সালমান এফ রহমান। মোহাম্মদ শাহ আলম সারওয়ার ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আইএফআইসি ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সদরঘাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা চলমান আছে।
তার আগে আইএফআইসি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল আগে প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর নেতৃত্বাধীন পর্ষদের হাতে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এরপর থেকেই ব্যাংকটিতে আর্থিক অনিয়মের যুগ শুরু হয়।
২০১০ সালে ব্যাংকটিতে সরকারের শেয়ার ৪৯ শতাংশ হলেও পরে তা কমে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়। ফলে সরকার মনোনীত পরিচালকরা নামে মাত্র পর্ষদে ছিলেন। অবশিষ্ট ৫১ শতাংশ শেয়ার বেসরকারি খাতের স্পন্সর ও শেয়ারহোল্ডারদের হাতে ছিল। ব্যাংকটির পর্ষদে জায়গা করে নিতে সে সময় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে এক দফায় (ওয়ান শট) ১১০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন সালমান। ২০১০ সালের পর্ষদে থাকা সরকারের প্রতিনিধি পরিচালক বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সচিব আরাস্ত খান এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) খবরের কাগজকে আরাস্ত খান বলেন, আমার মনে আছে ওই সময় মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বাদল ছিলেন পর্ষদে। হঠাৎ করেই সালমান সাহেব ১১০ কোটি টাকা পরিশোধ করলেন। ওই দিনই পর্ষদ সভা হলো। তিনি পরিচালক ও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। তার (সালমান এফ রহমান) সঙ্গে কাজ করা কঠিন ছিল। তিনি সব সময় দুই নাম্বারি চিন্তা-ভাবনা করতেন। আর তার এসব ফন্দি-ফিকির আর্থিকবিষয়কে কেন্দ্র করে হতো।
সালমান নেতৃত্বাধীন পর্ষদ থাকাকালে ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল কাজ করতে না পারা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একজন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সময়টা ২০১৬ সাল হবে। আমি ও আমার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ব্যাংকটিতে পরিদর্শনে গেলে আমাদের রিসিপশন থেকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়নি। অপমানিত হয়ে আমরা ফিরে এসেছি। আর উপরে উঠিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আগে ও পরে কোনো কর্মকর্তা ব্যাংকটিতে অ্যাক্সেস (প্রবেশাধিকার) পায়নি। অন্য ব্যাংকগুলোর অনেকেই এ বিষয়টি জানতো। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য দুঃখজনক ছিল। তাদের ক্ষমতার দাপটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু করতেও পারত না। আইএফআইসি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অসংখ্য চিঠির জবাব দেয়নি।’
যোগাযোগ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি যতটুকু জেনেছি পরিদর্শন দলের সদস্যদের অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত। এখন সময় পাল্টেছে। নতুন পর্ষদ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই সব আর্থিক অনিয়ম বের করে আনবে এবং ব্যাংকটিতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করবে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত ৪ সেপ্টেম্বর আইএফআইসি ব্যাংকের পূর্বতন পর্ষদ বাতিল করে ছয় সদস্যের নতুন পর্ষদ নিয়োগ দেয়। বাদ পড়েন সালমান ও তার ছেলে সায়ান। নতুন পর্ষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকটিতে গত ১৫ বছরে সংঘটিত সব অনিয়ম চিহ্নিত করে আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র নিরূপণ করার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সুপারিশ দেওয়া। গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটির নতুন পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ দিন সন্ধ্যায় নবনিযুক্ত পর্ষদ চেয়ারম্যান মো. মেহমুদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আগে যেসব আর্থিক অনিয়ম হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমাদের ওপর দায়িত্ব হলো সামনের দিনগুলোতে ব্যাংকটির পরিচালনায় করপোরেট সুশাসনের উন্নতি ঘটানো। আমরা সে বিষয়টাতে মনযোগ দিয়েছি। ব্যাংকটিতে দক্ষ জনবল রয়েছে। আশা করছি আর্থিক অবস্থারও উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে। আমরা ভালো কিছু করতে চাই।
এদিকে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটিতে সরকারের শেয়ার কমে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। পাকিস্তানের একটি ব্যাংকে আইএফআইসির মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ ছিল যা পরবর্তীতে কমিয়ে আনা হয়েছে। এর বাইরে নেপালের একটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইএফআইসির বিনিয়োগ রয়েছে। ১৯৭৬ সালে সরকারি মূলধন ও ব্যবস্থাপনায় আইএফআইসি ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৩ সালে এই ব্যাংকের ৫১ শতাংশ বেসরকারি স্পন্সর ও শেয়ারহোল্ডারদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আরাস্ত খান এ বিষয়ে বলেন, সরকার মনোনীত পরিচালকদের সালমান এফ রহমান ও তার সহযোগীরা ‘বি’ গ্রেডের পরিচালক হিসেবে দেখতেন। এটি দুর্ভাগ্যজনক ছিল।