
চট্টগ্রাম থেকে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি গত তিন বছরে প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাসের কারণে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ভেনামি চিংড়ির প্রতিযোগিতা বাড়ায় বাংলাদেশি চিংড়ির ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে খামারিরা বিপদে পড়েছেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের মৎস্যজাত রপ্তানি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৮০ দশমিক ৩৮৩ টন চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৩৩৬.২৯০ মার্কিন ডলার। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ২২৪ টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল ৫ কোটি ৬৯ লাখ ৪৯ হাজার ৯৭৬ মার্কিন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৪৫৩ দশমিক ১৬৫ টন, যার বিপরীতে আয় হয়েছিল ৮ কোটি ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬৩৪ মার্কিন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু না হওয়া, চাষের জমি কমে যাওয়া এবং কাঁচামালের সংকটের কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ফলে অনেক চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আগে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে শতাধিক লাইসেন্সধারী রপ্তানিকারক চিংড়ি রপ্তানি করতেন; বর্তমানে রপ্তানি করছেন মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠান।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল, যার বাজারমূল্য ছিল আনুমানিক ৫৭ কোটি ডলার। ঠিক এক যুগ পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টন, আর্থিক অঙ্কে যা প্রায় ২৪ কোটি ডলার। এক যুগে চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশ থেকে ৫২ শতাংশ কমেছে।
ইপিবির তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু অর্থবছর শেষে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি করা সম্ভব হয়। ওই কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, যা শেষে নেমে আসে মাত্র ২৪ কোটি ডলারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে চিংড়ি রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা হলেও সেই পরিমাণ অর্থের চিংড়ি রপ্তানি করা যায়নি।
চট্টগ্রামের বিডিসি ফুডস লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশের চিংড়ির চাহিদা কমে গেছে বহির্বিশ্বে। ওই জায়গা দখল করছে ভেনামি চিংড়ি। ভেনামি আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না, কম জায়গায় এ চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব, তাই এটি লাভজনক। আমাদের দেশে চিংড়ির উৎপাদন কমে গেছে। খামারিরা চিংড়ি চাষ করে টিকে থাকতে পারছেন না। ফিডের দাম, পোনার দাম বেশি। আবার চিংড়িতে মড়ক ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ ফ্রোজেন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আশরাফ হোসাইন বলেন, ‘হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি প্রতি বছরই কমছে। আমাদের ব্যবসা ঠিক রাখতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মৎস্যজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছেন। ব্যাংকের সুদ দিতে না পেরে অনেকে কারখানা বিক্রি করে দিয়েছেন। আমাদের দেশে ভেনামি জাতের চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় আমরা আন্তর্জাতিক বাজার হারিয়েছি।’
এপেক্স ফুডস লিমিটেডের মোহাম্মদ মোমেন বলেছেন, ‘বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি কেজি চিংড়িতে যে পরিমাণ মূল্য পাওয়া যেত, এখন সে মূল্য পাওয়া যায় না। কারণ, বিদেশে ভেনামি চিংড়ি কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। আসল চিংড়ির বাজারটি ভেনামি চিংড়ি দখল করে নিচ্ছে।’
প্যাসিফিক সি ফুডস লিমিটেডের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহেদ বলেছেন, ‘দেশে ব্যাপক আকারে ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু হোক। খামারি আমাদের সরবরাহ করতে পারলে আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। বিদেশে যেহেতু এ চিংড়ির চাহিদা রয়েছে, উৎপাদন ব্যাপক আকারে শুরু করতে সমস্যা কোথায়? বিশ্ববাজারে এখন ৯৫ শতাংশই ভেনামি চিংড়ি, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির মধ্যে ৯৫ শতাংশই বাগদা চিংড়ি। ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষের উৎপাদন খরচ ২৫-৩০ শতাংশ কম। তাই কম উৎপাদনশীল গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন।’