উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাবে পুঁজিবাজারে যারা মার্জিন লোন নিয়ে বিনিয়োগ করতেন, তাদের ব্যয় বেড়ে গেছে। এর ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার চেয়ে ব্যাংকে টাকা জমা রাখাকে নিরাপদ মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকার, ডিলাররা বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দিয়ে থাকে। একে মার্জিন ঋণ বলে। আর এসব জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন তারা। ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্জিন ঋণে এখন ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। এর ফলে আগে যারা মার্জিন ঋণ নিয়েছেন তাদেরও বেশি সুদের বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্জিন লোন দেওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সুদহার সমন্বয় করেছে। অর্থাৎ কয়েক মাস আগে কম সুদে ঋণ দিলেও, এখন সুদহার বেড়ে যাওয়ায় তা বাড়তি সুদে সমন্বয় করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্জিন লোন নিয়ে ইনভেস্ট করা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো মার্জিন ঋণে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে মার্জিন লোন নিয়োগ ইনভেস্ট করলে বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহার ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েছে। যার কারণে বেড়েছে মার্জিন ঋণের সুদও।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো, ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহারও বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি হলে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হবে। এটি বাড়িয়ে সাড়ে এগারো শতাংশ পর্যন্ত করা হতে পারে।
আরেক স্টক ব্রোকারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণের সুদহার যত বৃদ্ধি পাবে, মার্জিন নিয়ে ইনভেস্ট করা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি তত বাড়বে। তাই পোর্টফোলিও ভালো অবস্থায় না থাকলে এই মুহূর্তে মার্জিন নিয়ে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গত এক দশক আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন শুরু করেন শহিদুল ইসলাম। বর্তমানে তার মার্জিন ঋণের বিনিয়োগ রয়েছে ১০ লাখ টাকা। তবে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা সংকটের কারণে অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমেছে। ফলে তিনি শেয়ার বিক্রি করেনি, এতে বিনিয়োগ থেকে আসেনি কোনো মুনাফা।
তিনি বলেন, লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েও মার্জিনের সুদ পরিশোধ হবে না। ফলে পকেট থেকে মার্চেন্ট ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করতে হবে তাকে।
তার মতো এমন হাজারও মার্জিন ঋণের বিনিয়োগকারীরা এখন সমস্যায় পড়েছেন। একদিকে সুদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে পুঁজিবাজারে আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। দিন দিন অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর কমছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে দ্রুত সুদের হার বাড়ানো, পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন সুশাসনের অভাব, ভালো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক সময়ে দরপতন অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক আমানতে সুদের হার বেশি পাওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছাড়ছেন।
সুদহারের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের তারল্য সংকটের প্রভাবও পড়ছে পুঁজিবাজারে। এ বিষয়ে আইসিবির চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দেশে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ার ফলে ব্যাংকে টাকা জমা রাখাটাকে নিরাপদ মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। তারল্য সংকটের কারণে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো ২০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনতে পারেনি। আস্থা সংকটের কারণে পুঁজিবাজারও তারল্য সংকটে ভুগছে। পুঁজিবাজারে এখন যে নিম্নমুখী অবস্থা তার অন্যতম কারণ সুদের হার বেড়ে যাওয়া, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের প্রভাব।