ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন সম্প্রতি ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশটির সেমিকন্ডাক্টর শিল্প উন্নয়ন কৌশল এবং ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই খাতে তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দিয়েছেন। এর পর থেকেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভিয়েতনামের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইতিবাচক পর্যালোচনা করছে। মূলত ভিয়েতনামের এই উদ্যোগের পর থেকেই বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে দেশটির সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। খবর ভিয়েতনাম টাইমসের।
হংকংভিত্তিক এশিয়া টাইমসের খবরে বলা হয়, ভিয়েতনাম বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠছে। অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করা উচ্চশিক্ষিত, উদ্যোগী প্রকৌশলীরা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ও প্যাকেজিং কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
একই ধরনের মত ব্যক্ত করে লন্ডনভিত্তিক প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম ইন্টেলিজেন্টশিও বলেছে, বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে ডিজিটাল রূপান্তর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সেমিকন্ডাক্টর উপাদানের মতো উচ্চ প্রভাবশীল খাতগুলোতে ভিয়েতনাম নিজেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
ডি হিউজ গ্রুপের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক গ্যাবর ফ্লুইট বলেন, ‘ভিয়েতনাম যে ধরনের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে, তার অংশ হিসেবে দেশটি এখন উচ্চপ্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতগুলোতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। সেই সঙ্গে উদ্ভাবন ও উচ্চমানের চাকরির ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। অনেক কোম্পানি ভিয়েতনামকে বেছে নিচ্ছে কারণ, এখানে ভালো মানের প্রতিভা রয়েছে, তবে আমাদের সেই সম্পদ বা প্রতিভাকে আরও বড় করার চেষ্টা করতে হবে।’
ভিয়েতনাম টাইমসের খবরে বলা হয়, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উন্নয়ন বাড়ানোর জন্য দেশটি আইনগত ও প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
থাইল্যান্ডের দ্য নেশন পত্রিকা উল্লেখ করেছে, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর সবাই- নিজেদের এই অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম একটি নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করছে, যার আওতায় দেশে বিনিয়োগকারী বিশ্বব্যাপী চিপ নির্মাতাদের বেশ কিছু প্রণোদনাও দেবে তারা।
জাপানভিত্তিক নিক্কেই এশিয়ার মতে, ভিয়েতনাম কর হ্রাস থেকে শুরু করে দ্রুত রপ্তানি পদ্ধতি পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে চিপ উৎপাদক কোম্পানিগুলোর জন্য প্রণোদনার একটি তালিকা তৈরি করছে।
ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পঙ্কজ ঝা বলেছেন, বর্তমান সময়ে ভিয়েতনামে সেমিকন্ডাক্টর ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত সমগ্র ইকোসিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ। আমার পরামর্শ হলো ভিয়েতনামকে তাইওয়ান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো সেমিকন্ডাক্টর শক্তিধরদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত এবং দেখা উচিত যে, তারা কীভাবে চিপ উৎপাদনকে তাদের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি করে তুলেছে এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের আরও শিখতে হবে। এই প্রয়োজনীয় ইকোসিস্টেম তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাত- উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে ভারতীয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা অনুসারে, ভিয়েতনাম শ্রম-নিবিড় শিল্প থেকে নিজেদের উচ্চপ্রযুক্তি খাতে স্থানান্তর করার চেষ্টা করছে। দেশটির লক্ষ্যমাত্রা হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের ৫০ হাজার সেমিকন্ডাক্টর ইঞ্জিনিয়ার থাকবে।
সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (এসআইএ) প্রেসিডেন্ট ও সিইও জন নিউফার বলেছেন, ‘আমরা ভিয়েতনামের এই কৌশলকে স্বাগত জানাই এবং এটা দেখে খুশি হচ্ছি যে, ভিয়েতনাম এই শিল্পের চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোর মধ্যে একটি, যা হলো সেমিকন্ডাক্টর এবং এআই জনশক্তি প্রশিক্ষণের ওপর মনোনিবেশ করেছে। এটি দীর্ঘ যাত্রার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে দেশটির প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর একটি।’ জন নিউফার নিজের আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করে বলেন, যেকোনো দেশ যদি মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোনিবেশ করে, সঠিক পথে থাকে এবং সঠিক নীতিমালা থাকে- তবে তারা শিগগিরই সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অর্জন করবে।
১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর বাজারে যাত্রা
আমেরিকান প্রযুক্তিগত গবেষণা ও পরামর্শক সংস্থা গার্টনার ইনকরপোরেটেডের পূর্বাভাস অনুযায়ী, সেমিকন্ডাক্টর শিল্প ২০২৪ সালে ৬২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব আয় করবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। সম্প্রতি তারা সেমিকন্ডাক্টর স্ট্র্যাটেজি প্রকাশ করেছে, যেখানে ভিয়েতনাম এই বিশাল বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে জন নিউফার বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে ভিয়েতনাম আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে আরও বড় ভূমিকা পালন করার জন্য অপার সম্ভাবনা রয়েছে।’
আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি এএমডির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কেইথ স্ট্রিয়ার মানুষ, ইকোসিস্টেম, ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং নীতিমালাসহ সেমিকন্ডাক্টর ও এআই শিল্পের বিকাশের জন্য চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তুলে ধরেছেন। স্ট্রিয়ার জোর দিয়েছেন, ‘আত্মনির্ভর অর্থনীতির জন্য এআইয়ের বিকাশ ও সমন্বয় প্রয়োজন, যা সম্পূর্ণ দক্ষ ও স্বচ্ছ এআই ব্যবহারের লক্ষ্যে বাস্তবায়ন করা জরুরি। আমরা এই ভিশন বাস্তবায়নে ভিয়েতনামের সঙ্গে অংশীদারত্ব করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিনিয়োগকারীরা তাদের সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল বৈচিত্র্য আনতে চাইলে ভিয়েতনাম এই বিনিয়োগের বিশাল ঢল থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য একটি ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে এটি স্পষ্ট যে, দেশটির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনের জন্য আরও কিছু উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে।
বিশ্বের ৮১ শতাংশ সেমিকন্ডাক্টরই এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এই দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, জাপান ও ভারত। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তাইওয়ান। সেমিকন্ডাক্টর বাজারের ৬০ শতাংশ রয়েছে দেশটির দখলে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা মেটাতে তাইওয়ানের ওপর নির্ভর করে। দেশটিতে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বা টিএসএমসি। অন্য কোম্পানিগুলোর দেওয়া অর্ডার অনুযায়ী, সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করে টিএসএমসি। ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, সিপিইউ ও জিপিইউসহ নানা পণ্য উৎপাদন করে তারা। বর্তমানে তাদের বাজার মূলধন ২১ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন তাইওয়ান ডলার। আর তাদের কর্মী সংখ্যা ৫৪ হাজার ৯৭৪।