সম্প্রতি দেশের কারখানাগুলোয় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। এতে কারখানার শান্তি ও শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা পেলে দেশের পোশাক খাতের রপ্তানি আয় বর্তমানের চেয়ে আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের ডেলমাস গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন। সম্প্রতি খবরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুস সাত্তার।
খবরের কাগজ: আপনার পোশাক কারখানা ও ব্যবসা কেমন চলছে?
মোহাম্মদ হোসেন: মোটামুটি চলছে। কিছু অর্ডার আছে, সেগুলো দিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে কোনো রকমে কারখানা টিকিয়ে রেখেছি। আমাদের বিশ্বাস, একসময় দেশের পোশাক খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। এ লক্ষ্য নিয়েই আমরা বন্ধ না করে চালিয়ে যাচ্ছি। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আমাদের পোশাক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
খবরের কাগজ: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি?
মোহাম্মদ হোসেন: জাতিসংঘের অধিবেশনে যাওয়ার আগে আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছি। বিজিএমইএ নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে জিএসপি বিষয়ে অবহিত করেছেন। দেশের তৈরি পোশাক খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করতে হবে। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন এবং সম্মতি জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। তিনি বৈষম্যের শিকার হওয়া এই পোশাক খাতের দিকে নজর দেবেন। আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাত আবার প্রসারিত হবে। আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে। দেশের মানুষের ঘরে ঘরে চাকরি সৃষ্টি হবে। দেশের উন্নয়ন হবে। দেশ এগিয়ে যাবে।
খবরের কাগজ: বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্টসশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে কেন?
মোহাম্মদ হোসেন: ঢাকার আশুলিয়া, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। এর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। গত সরকার যেভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে অনুযায়ী শ্রমিকরা মেনে নিয়েছেন। সব মালিক বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করেছেন। সুতরাং কোথাও ঝামেলা থাকার কথা না। তবে যেখানে সমস্যা হচ্ছে, সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন সেনাবাহিনী। তারা গার্মেন্টসের প্রতি অনেক আন্তরিক। সুতরাং সুন্দর ও সঠিকভাবে কারখানা এগিয়ে যাক, এটিই কামনা করি।
খবরের কাগজ: দেশের পোশাক খাতে বায়ারদের নতুন করে ফেরানোর জন্য করণীয় কী?
মোহাম্মদ হোসেন: আমাদের দেশের পোশাকের চাহিদা বিশ্বজুড়ে রয়েছে। ইউরোপে পোশাক অবাধে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু জিএসপির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তা সম্ভব নয়। যদি জিএসপি সুবিধা পাওয়া যায়, তবে বায়াররা বাংলাদেশে আবার ফিরে আসবে। কারণ একসময় যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ রপ্তানি হতো। কিন্তু এখন ১৮ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এক যুগ আগে কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা কম ছিল। ২০১৩ সালের আগে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। বিগত সরকার এসব নিয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে রেখেছিল।
খবরের কাগজ: গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, দেশে কেন তৈরি হয় না?
মোহাম্মদ হোসেন: আমরা বারবার বিগত সরকারকে বলেছি, দেশেই সুতা, কাপড় ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজের কারখানা করা হোক। কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দেয়নি। এবার কিছু কারখানা মিরসরাই শিল্পজোনে স্থাপন হয়েছে। সেখানে উৎপাদন শুরু হলে বিদেশের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। আমাদের গার্মেন্টসশিল্পকে আরও মসৃণ করা প্রয়োজন। কারণ গার্মেন্টস দেশের উন্নয়নের গেটওয়ে।
খবরের কাগজ: গার্মেন্টসশিল্পের অগ্রগতিতে কী কী বাধা আছে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ হোসেন: গার্মেন্টসশিল্পের অগ্রগতিতে বাধা বলতে আমি কিছুই দেখছি না। সরকার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে এই শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ শিল্পের অগ্রগতির জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার গার্মেন্টস মালিকদের পাশে দাঁড়ালে এই খাত এগিয়ে যাবে। দেশে ডলারসংকট থাকবে না। দেশ আরও উন্নতি করবে। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন শিল্পজোনে চীনের বিনিয়োগকারীরা আসছেন। তারা পারলে আমরা কেন পারব না?
খবরের কাগজ: গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী?
মোহাম্মদ হোসেন: পোশাক তৈরি করে রপ্তানির পর যদি কোনো কারখানার মালিক পুঁজিতে সমস্যা অনুভব করেন, তখন তার মূলধনের ওপর চাপ পড়ে। একসময় দেখা যায়, তিনি অনেক টাকার ঋণের মধ্যে পড়ে গেছেন। এরপর চেষ্টা করেন ঘুরে দাঁড়ানোর। না পারলে, তাকে কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়। তখন সরকারের উচিত ওই গার্মেন্টসের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু সরকারের কোনো দপ্তরই গার্মেন্টের সুযোগ-সুবিধা ভালোভাবে দেখভাল করে না। সরকার যদি কম সুদের ঋণ দিতে পারে, তাহলে গার্মেন্টসগুলো টিকে থাকতে পারবে।
খবরের কাগজ: ডলারসংকট ও ব্যাংক বন্ধের প্রভাব পড়েছে কি?
মোহাম্মদ হোসেন: ডলারসংকটে গার্মেন্টে তেমন প্রভাব না পড়লেও সম্প্রতি ব্যাংক বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে কষ্ট হয়েছে। একসঙ্গে অনেক ব্যাংক বন্ধ থাকায় লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে উপদেষ্টাদের একেক দিন একেক কথা বলায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাই সরকারের উচিত হবে, কীভাবে কারখানা চালু রাখা যায়, ওই দিকে নজর দেওয়া।