আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম হয় ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই)। ফলে গ্রাহকের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না তারা। তৈরি হয়েছে আস্থাহীনতা।
এমন পরিস্থিতিতে তিন মাসের ব্যবধানে ৪৭ হাজার আমানতকারী এনবিএফআই ছেড়ে চলে গেছেন। তবে এই সময়ে আমানত সামান্য বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে লিজ ও ঋণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত জুন ২০২৪-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের যোগসাজশে যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিতরণ করা হয়েছে ঋণ। এখন আদায় করতে পারছে না। আবার অনেক ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেই। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্যভাণ্ডার বা সিআইবিতে গ্রাহকের তথ্য হালনাগাদ না থাকায় অনেক গ্রাহককে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে অর্থসংকটে প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারছে না, পড়েছে মূলধনসংকটে। কিছু প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এমন অবস্থায় অস্তিত্বহীনতায় পড়েছে বেশ কিছু এনবিএফআই। যার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যেভাবে তদারকি করার দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। এখন গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৪১ জন। আর জুন শেষে অর্থাৎ তিন মাস পর আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৭ জন। সেই হিসাবে তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে ৪৭ হাজার ৬০৪ জন। একক প্রান্তিকে আমানতকারী কমার সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।
এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি (আইআইডিএফসি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, জুন প্রান্তিকে আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে। আসলে এই সময়ে সরকারের বিল-বন্ডের সুদহার বেশি থাকায় আমানতকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে সেখানে রেখেছেন। গ্রাহক টাকা রাখেন লাভের জন্য। যেখানে বেশি লাভ পাবেন, সেখানেই তারা যাবেন।
নানা অনিয়মের কারণে মানুষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণে আমানত তুলে নিচ্ছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে কিছু আস্থার সংকট আছে। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে গ্রাহকের আস্থা বাড়ানো যায়।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল ৩ হাজার ৮৮০ জন। এর আগে ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল ২৫ হাজার ৭৮২ জন। এর আগের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এ সংখ্যা কমেছিল ১৮ হাজার ৪৯৩ জন। এ ছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) এ সংখ্যা কমেছিল ৩৫ হাজার ৫ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুন প্রান্তিকে এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে ৮ হাজার ১১৩ কোটি ৯ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর তিন মাস পর (এপ্রিল-জুন) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩৮৮ কোটি টাকা।