
একসময় পেইন্টের ব্যবহার হতো শুধু এ দেশের ধনী ব্যক্তিদের বাড়িঘর, অফিস, আদালতসহ বিভিন্ন স্থাপনাতে। কিন্তু গত ১০ বছরে এ ধারায় পরিবর্তন এসেছে। পেইন্ট ব্যবহার করা হলে বাড়িঘরে স্থায়িত্ব বাড়ে। খরচ বাড়লেও উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণিও পেইন্ট ব্যবহার করছে। ফলে পেইন্টের বাজার বাড়ছে। তবে ডলারসংকটের কারণে পেইন্টের দাম বেড়েছে।
শুধু স্থায়িত্বই না, ইদানীংকালে ঘর বানানোর সময় দৃষ্টিনন্দন অন্দরসজ্জারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সাধারণ মানুষ। আর ঘরের সাজসজ্জায় অন্যতম অনুষঙ্গ হলো বিভিন্ন রঙের পেইন্টের ব্যবহার। এক কথায় বলা যায়, দ্রুত বিকাশমান নির্মাণ খাত এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইনের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ বাড়ার কারণেও পেইন্টের ব্যবহার বেড়েছে। প্রতি বছরই বেড়েছে পেইন্টের বাজার। এই বাজার বৃদ্ধির হার ৮-১০ শতাংশ। জীবনযাত্রার মানে যত বেশি পরিবর্তন আসছে, ততই বাড়ছে পেইন্টের বাজার পরিধি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেইন্টের বাজারে মূলত দাপট দেখাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানির মার্কেট শেয়ারের পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ দেশীয় কোম্পানির দখলে রয়েছে। এর মধ্যে মোটা দাগে ৫৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ। ১৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে এর পরের অবস্থানে রয়েছে এশিয়ান পেইন্টস। এ ছাড়া বাজারে অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে নেদারল্যান্ডসের একজোনোবেল, জাপানের নিপ্পন পেইন্ট এবং নরওয়ের জতুন পেইন্টস।
সাধারণ মানুষের চাহিদা সামনে রেখে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে পেইন্ট ও গৃহসজ্জা (ডেকোর) ইন্ডাস্ট্রির উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। এসব শিল্পকারখানায় উৎপাদন ও ব্যবহার দুটোই বেড়েছে।
দেশের বাজারে গ্রাহক ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত নিত্যনতুন পণ্য বাজারে আনছে বলে জানা গেছে। দেশীয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু পেইন্টের খরচ ছিল প্রায় শূন্য দশমিক ৯৬ কেজি। যেখানে ভারতে প্রতি বছর এই খরচ হয় ৩ দশমিক ৩৪ কেজি।
অন্যদিকে পেইন্ট শিল্পের বাজার দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন টাকা। যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। গড়ে বার্ষিক খরচ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টন। দেশে বর্তমানে ৪০টি কাঠামোবদ্ধ এবং ২০টিরও বেশি অকাঠামোবদ্ধ রং প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টি বড় কোম্পানি প্রায় ৮৫ শতাংশ গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করছে।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম পেইন্টিং কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে এলিট পেইন্টসের হাত ধরে। এর এক বছর পরই পেইন্টিং ইন্ডাস্ট্রিতে আসে রকিস পেইন্টস। এরপর একে একে বাংলাদেশ কার্যক্রম শুরু করে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পেইন্টিং কোম্পানি। এর মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে বার্জার এবং এশিয়ান পেইন্টস।
১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান পেইন্টস সারা বিশ্বে দশম অবস্থানে এবং এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এর বাইরে আরও রয়েছে পেইলাক পেইন্ট, আল করিম পেইন্টস, উজালা পেইন্টস। ব্যাপক নগরায়ণ ফলে বাংলাদেশে রংশিল্পের বিকাশ ঘটেছে খুবই দ্রুত।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পেইন্ট প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী কোম্পানি বার্জার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের রংশিল্পের বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। এর প্রথম সারিতে রয়েছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ। উন্নত গুণগত মানসম্পন্ন এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন করে এ খাতের উন্নয়ন নিশ্চিত করে যাচ্ছে এ কোম্পানি।
রূপালী চৌধুরী আরও বলেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। তারা খরচ বেশি হলেও তারা পেইন্ট ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। এর মূল কারণ পেইন্ট ব্যবহার করলে স্থাপনার স্থায়িত্ব বাড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ডলারসংকটের কারণে পেইন্টের খরচ বাড়ছে। দেশে তৈরি করলেও খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি করা পেইন্টের খরচও বেড়েছে। তবে ভোক্তার কথা ভেবে আমরা মুনাফা কমালেও দাম তেমন বাড়াচ্ছি না। পেইন্ট খাতের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সাধারণ মানুষের হাতে কম দামে পেইন্ট দিতে হলে সরকারকে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে। আমদানিতে আরও ছাড় দিতে হবে।
এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের কান্ট্রি ম্যানেজার রিতেশ দোশী জানান, ‘উদ্ভাবনী স্পৃহা আর ভোক্তা চাহিদাকে সামনে রেখে ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে এশিয়ান পেইন্টস। ২০১৭ সালে এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশে চালু করেছে কালার আইডিয়াস স্টোর; যা রঙের বিপণন ও পরিবেশনায় সম্পূর্ণ নতুন সংযোজন। এই স্টোর এরই মধ্যে বিক্রেতা ও ভোক্তা মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এর মাধ্যমে ভোক্তারা রং পছন্দের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও রং প্রয়োগে দেয়াল কেমন দেখাবে তা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ভোক্তাদের প্রয়োজনের কথা ভেবেই আমাদের সব প্রচেষ্টা। তাদের চাহিদা বিবেচনা করে আমরা এ বছরেই ইজিকালার ও ইজি পেইন্টিং নামে আরও দুই ধরনের সেবা চালু করেছি, যা ভোক্তাদের বাড়ি রং করানোর সব ঝক্কি দূর করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বাড়ির দেয়াল ও ছাদ ওয়াটারপ্রুফ করতে প্রয়োজনীয় তেমন কোনো সম্পূর্ণ পণ্য বা সমাধান নেই। আমরাই প্রথম বাংলাদেশের বাজারে বাড়ির সব ধরনের ওয়াটারপ্রুফিং করতে নিয়ে এসেছি স্মার্টকেয়ার নামের সম্পূর্ণ সমাধান।
রেইনবো পেইন্টসের নির্বাহী পরিচালক মো. কামরুল হাসান বলেন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ হলে কর্মসংস্থান হয়, ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়া যায়। কারণ অনেকেই অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশের একটি ভালো কোম্পানি পেইন্টস ব্যবসায় আসুক। তাহলে একটি ভালো প্রতিষ্ঠান তাদের ওপর ভরসা করতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালে রেইনবো পেইন্টসের যাত্রা শুরু হয়। পেইন্ট ব্যবসায় বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বেশির ভাগ বাজার দখল করে আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে এই শিল্প খাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসা উচিত এবং এই ভাবনা থেকেই আমরা রেইনবো পেইন্টস শুরু করলাম। পেইন্ট শুধু ঘরবাড়িতে নয়, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ যেহেতু এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি হচ্ছে এজন্য আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেইন্টেও ব্যাপক জোর দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এ ব্যবসা বাংলাদেশে আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।